কিভাবে যাবেন বিস্তারিত-সৌন্দর্যে ঘেরা শিপচর

 

অপরূপ বাংলাদেশ যেন প্রকৃতির এক অজস্র সৌন্দর্য। আছে সমুদ্র, পাহাড়, মোহনীয় ঝরনা, জলপ্রপাত, নদী, হাওর, বাঁওড়সহ আরো কতো কিছুর লীলাভূমি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের যেন এক অপার বিস্ময় আমাদের বাংলাদেশ ৷

ভ্রমণ সবসময়ই মনকে বিনোদিত করে। প্রকৃতির মাঝে হারানোর এক ভিন্ন ধরনের আনন্দ আছে। আছে সুখানুভূতি, যা মানব মনকে দীর্ঘদিন ভালো লাগার, ভালোবাসার ছোঁয়া দিয়ে যায়। তাই সবার মাঝেই দেশকে দেখার, দেশকে জানার, প্রকৃতির মাঝে অবগাহন করার এক উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করা যায় ৷ ভূ-প্রকৃতিঃ বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও রূপ, লাবণ্যের কথা বলে শেষ করা যায় না। যতই বলি মনে হয় যেন কম বলা হয়েছে ৷ বাংলাদেশে যে কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে যে কোন দিকেই দৃষ্টিপাত করি না কেন চোখ দুটো প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখে ধন্য হয়, মনপ্রাণ আনন্দে ভরে ওঠে। কি পাহাড় টিলার রমনীয় শোভা, কী গাছপালা ও তৃণমূল শোভিত বনের মনোরম দৃশ্য, কী কলনাদিণী নদনদীর অপরূপ সৌন্দর্য, কী শ্যামল শোভাময় ফসলের ক্ষেত সবই এদেশে সুন্দর ও অনুপম ৷

বাংলাদেশের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হলো ভোলা জেলার শিপচর, আমরা একটি ভ্রমণ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সবাইকে আকর্ষিত দিতে চাই ৷

প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের মাঝে কিছু সময়ের জন্য আমরা পনেরো বন্ধু এক ভিন্ন ধরনের প্রকৃতির সৌন্দর্যের খোঁজে বের হলাম। আমরা বের হয়েছি সমুদ্রের মাঝে ছোট্ট এক দ্বীপ দেখতে। দেশের সর্ব দক্ষিণের জেলা ভোলার চারপাশে সমুদ্রের মাঝে চর কুকরি-মুকরি, নারিকেল বাগান, কুলিয়ার চর, ঢালচর আর সবচেয়ে সুন্দর শিপচর। এই শিপচরই আমাদের গন্তব্য।

যাতায়াত ব্যবস্থা যথারীতি রাজধানীর সদরঘাট থেকে লঞ্চে আমাদের ভোলার চরফ্যাশনের উদ্দেশে যাত্রা শুরু ৷ চরফ্যাশনে পৌছে সকালে নাস্তা সেরে আবার ট্রলারে সবুজ শ্যামলে ভরপুর চর কচ্ছপিয়া থেকে আমাদের সমুদ্রযাত্রা শুরু। কিছুদূর বাদে প্রকৃতির আর এক নিসর্গ ভূমি চর কুকরি-মুকরি দর্শন। আমি এই প্রথম দেখলাম- সবুজ ঘাসে জড়ানো সমুদ্রসৈকত। যেখানে আপন খেলায় মত্ত হয়ে আছে নাম জানা-অজানা হরেক রকমের পাখি ৷ একটু পরেই আমাদের সমুদ্র গভীরে যাত্রা শুরু। নীল সমুদ্রের জলকণার মাঝে আমাদের উল্লাসে এগিয়ে চলা। সবার গায়েই লাইফ জ্যাকেট। গানের সুরে, আড্ডার মাঝে আমাদের সমুদ্র যাত্রা, যেন সমুদ্র হয়ে ওঠার এক অদ্ভুত প্রচেষ্টা। কিন্তু হঠাৎ সমুদ্র যেন তার রাক্ষুসে রূপ ধারণ করল। বিশাল বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে নৌকার গায়ে। ঢেউয়ের তোড়ে আমাদের ট্রলারে উপচানো পানি অনবরত ঢুকে যাচ্ছে ৷
একপর্যায়ে পানিতে টইটুম্বুর হয়ে উঠলো আমাদের ছোট্ট ট্রলারটি। যেন সাগর মাঝে আমাদের হতবিহ্বল আর আতঙ্কিত মুখগুলোর অপার স্তব্ধতা। ট্রলারের কাঠ ভেঙে পানি ঢুকে পড়ছে অনবরত। একপর্যায়ে হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেল নৌকার ইঞ্জিন। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা আর সাহসিকতায় আমাদের তরী আবার যাত্রা শুরু করল শিপচরের উদ্দেশে ৷

আমরা সব বাধা জয় করে পৌছলাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত সেই দ্বীপ শিপচরে। কথিত আছে, কোন এক সময় সমুদ্রের মাঝে এখানে একটি বড় জাহাজ ডুবে ছিল আর সেই থেকেই এ দ্বীপটির নাম শিপচর।
দ্বীপটিতে পৌঁছা মাত্রই সবাই যেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলাম। চারপাশে সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জনের মাঝে একটি ছোট্ট ব-দ্বীপ, যা আবার মাত্র ১০ মিনিটেই বৃত্তাকারে ঘুরে শেষ করা যায়। দ্বীপটির মাঝে ত্রিকোণাকৃতির এক ভূখণ্ড বা চর যা শুধু প্রকৃতির ভালোবাসায় বেড়ে উঠেছে। কিছু গাছ আর চারপাশে সৈকত ৷ থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা শুরু হলো আমাদের থাকার বন্দোবস্ত। তাঁবু খাটানো, রান্নার আয়োজন। বলে রাখা উচিত- এই ছোট্ট দ্বীপে সচরাচর মানুষের আগমন হয় না। মাঝে মাঝে জেলেরা বা মাঝিরা এখানে এসে একটুু বিশ্রাম নেয়, আবার মাছ ধরতে ফিরে যায়। খাবার-পানিসহ যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়ে আমরা গিয়েছিলাম ৷ আমাদের এই ট্যুর গ্রুপের লিডার আফজালের ব্যাপক প্রস্তুতিতে আমরা সব ধরনের দুশ্চিন্তামুক্ত থেকে শুধু প্রকৃতির সুধাপানে উন্মাদ ছিলাম। দ্বীপটি দেখলেই সমুদ্রের বিশালতার কাছে আমাদের অসহায়ত্ব অনুধাবন করা যায়। চারপাশে শুধু পানি আর পানি। সন্ধ্যায় দলবেঁধে সূর্যাস্ত দেখার পাশাপাশি সবাই মিলে সমুদ্রবিলাসে মেতে উঠলাম। সেইসঙ্গে চলল আমার ফটোগ্রাফি ৷ আমাদের গ্রুপের নাফিস, সুজন ভাই সবচেয়ে বড় উৎসাহ। রাতে শুরু হলো সমুদ্র গর্জনের মাঝে বারবিকিউ উৎসব। সমুদ্র থেকে জেলেদের ধরে আনা বিভিন্ন প্রজাতির মাছের বারবিকিউ। সমুদ্রের উচ্ছ্বাসের কাছে হার মানলো ইট, কাঠ, পাথর আর শহুরে ব্যস্ততা, কোলাহল আর পাওয়া না পাওয়ার হিসাব-নিকেশ। জলদ্বীপে আমরা ১৫ জন হারিয়ে গেলাম গভীরে, সমুদ্র অবগাহনে। অসীম শূন্যতায় বিমোহিত হয়ে সবাই সমুদ্র হয়ে গেলাম ৷ রাতে শুরু হলো গানের আসর। দলনেতা আফজালের গানের সুরে যেন আমাদের পাশাপাশি সমুদ্রের ঢেউ আর সবুজ বৃক্ষরাজির সুর মেলালো। অতিরিক্ত হিসেবে আমাদের মাঝে গায়েন এবং গাইড মজনু ভাইয়ের গাওয়া সেই বিখ্যাত গান ‘বন্ধু আমার বড় ভালোবাসতো ওই আকাশের চাঁদ, এখনও সে চাঁদ আমি একলা দেখি ক্যামনে সারারাত গো’ আমাদের মুখে মুখে ছড়িয়ে ছিল দীর্ঘদিন। পরদিন ভোরে সূর্যোদয়ে ছোট্ট দ্বীপটিকে যেন এক স্বর্গীয় ভূখণ্ড মনে হলো। কী অপরূপ সৌন্দর্য যে ভর করে আছে এই প্রকৃতিতে, আমার বাংলাদেশে তা চোখে না দেখলে আন্দাজ করা সম্ভব নয়। দিনের আলোতে আমাদের শুরু হলো মাঝসমুদ্রে জেলে হয়ে নৌকা নিয়ে মাছ ধরা। একটি অদ্ভুত বিষয় দেখলাম জেলেদের ব্যক্তিত্বে। তারা রাত-দিন জেগে জাল দিয়ে যে মাছ ধরেছে সেগুলো এক নিমিষেই আমাদের হাতে তুলে দিচ্ছে এবং কিছুতেই আমরা তাদের মূল্য মেটাতে পারলাম না। তাদের এককথা,
‘আপনারা আমাদের মেহমান’ ৷
তাদের ভালোবাসায় আমরা সিক্ত হয়ে মাছ নিয়ে ফিরে এলাম। আমাদের দু’দিন দু’রাত সেই নির্জন দ্বীপটিতে কাটিয়েছিলাম। প্রকৃতির অপরূপ সুধায় বিমোহিত হয়ে দেখেছি প্রিয় বাংলার রূপমাধুর্য। বাংলাদেশের সৌন্দর্য দেখতে ভ্রমণে বের না হলে যেন বিশ্বাস করা যাবে না এর রূপ-রহস্য। সমুদ্রের সেই দ্বীপটির প্রতি অদম্য ভালোবাসা আমাদের আত্মিক বন্ধনকে আরো বাড়িয়েছিল। ফেরার পথে আমরা আর এক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চর কুকরি-মুকরির পাশে নারিকেল বাগান ঘুরে এসেছিলাম। এখানে সমুদ্রের বেলাভূমিতে নানা জাতের বিশাল বৃক্ষরাজির মিথস্ক্রিয়া আর বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের তেড়ে আসা ঢেউয়ের সাথে প্রতিনিয়ত টিকে থাকার গল্প ৷