OrdinaryITPostAd

আওয়ামী লীগ এর প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে আলােচনা কর।

 


ভূমিকা : পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার (১৯৪৯) মধ্যদিয়ে বিরােধী রাজনীতির উত্থান ঘটে। আওয়ামী লীগই ছিল পাকিস্তানের প্রথম কার্যকর বিরােধী দল। তখন পাকিস্তান রাষ্ট্রে কোনাে বিরােধী দল গঠন সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল না। আওয়ামলীগ শুধু পাকিস্তানের প্রথম বিরােধী দল ছিল না, বাঙালির স্বার্থের সত্যিকার ও অপসহীন প্রতিনিধি হিসেবেও এর যাত্রা শুরু বাঙালিদের মধ্যে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। অচিরেই আওয়ামী লীগ এদেশের অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনীতির মূল স্রোতধারায় পরিণত হতে থাকে।

আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পটভূমি

 প্রায় দু’শত বছর ভারতবর্ষ ব্রিটিশদের শাসনাধীনে ছিল। ১৯৪৭ সালে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ভারত এবং মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে। নানা সমীকরণ, হিসাব-নিকাশে প্রথম দু’বছরের মধ্যে পাকিস্তানের রাজনীতি ও ভবিষ্যতের একটি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। মুসলিম লীগ ভেঙে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা হয়।



আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পেছনে বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিদ্যমান ছিল, নিম্নে তা আলােচনা করা হলাে-

১. ত্যাগী নেতাদের অবহেলা 

খােদ মুসলিম লীগের মধ্যে সুবিধাভোগী ও সুবিধাবাদী একটি উপদল সৃষ্টি হয়েছিল । তারা যেকোনাে পরিচয় ভাঙিয়ে প্রশাসনের নিকট থেকে নানাবিধ সুবিধা গ্রহণ করতে থাকে। বিশেষত পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানি থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের প্রশাসক নিয়ােগ হলে এ সকল বহিঃকর্মকর্তাগণ স্থানীয়দের সম্পর্কে কম জানার সুবাদে সুবিধাভােগি দলটি তাদের নিকট ভিড়ে যায় এবং অতিরিক্ত সুবিধা গ্রহণে নিজেদের স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। এতে ত্যাগী ও নিষ্ঠাবান মুসলিমলীগ কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হতে থাকে। তারা ক্রমশ দল থেকে ও প্রশাসন থেকে দূরে চলে যায়।

২. মুসলিম লীগের পাকিস্তানি ভাবনা 

পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী নিজেদের ক্ষমতা সুসংগঠিত ও বাধামুক্ত করতে একদল অনুগত বশংবদ তৈরি করার লক্ষ্যে মুসলিম লীগের একদল নেতাকে বিশেষ সুবিধা দিতে শুরু করে। এ ব্যাপারে খাজা নাজিমউদ্দিনের কথা বলা যায়। তিনি কেবল একদল সমর্থক গােষ্ঠীই তৈরি করেন নি; বরং তাদেরকে সরকারি গুণ্ডা হিসেবে গড়ে তােলার আগ্রহ দেখিয়ে ছিলেন। এদের বিশেষ ক্ষমতা ও সুবিধা খাজা নাজিমউদ্দিনকে পাকিস্তানে অগ্রহণযােগ্য করে তুলেছিল ।

৩. মােগলটুলী ওয়ার্কার্স ক্যাম্প 

পূর্ব বাংলার তরুণ লীগ কর্মীদের প্রধান কেন্দ্র ছিল ঢাকার ১৫০ মােগলটুলী পার্টি হাউজ ১৯৪৪ সালে আবুল হাশিমের নির্দেশে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। খাজা গ্রুপের হেড কোয়ার্টার্স ঢাকার ‘আহসান মঞ্জিলের বিপরীতে মােগলটুলী ওয়ার্কার্স ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ।



৪. গণতান্ত্রিক যুবলীগ ও ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা

সােহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর প্রথমে পাকিস্তানে এসে ভারতে থেকে যান। এর মূলে ছিল মুসলিম লীগ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের আচরণ। আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত বিভক্তি ও পাকিস্তানি সৃষ্টির পূর্বেই ১৯৪৭ সালের ৫ আগস্ট কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশে পূর্ব বাংলার জন্য মুসলিম লীগ সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে সােহরাওয়ার্দীর স্থলে লীগ হাইকমান্ডের প্রিয়ভাজন খাজা নাজিমউদ্দীন নতুন নেতা নির্বাচিত হয়ে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন। সােহরাওয়ার্দী-হাশিম সমর্থকরা সরকার ও দল উভয় থেকে উপেক্ষিত হতে থাকেন। এভাবে ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গণতান্ত্রিক যুবলীগ এবং ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

আরো পড়তে পারেনঃআওয়ামী মুসলিম লীগের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচির বিবরণ দাও।

আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা 

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলির কে. এম দাস লেনে অবস্থিত রােজ গার্ডেন হলে এক রাজনৈতিক কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে মাওলানা ভাসানীকে সভাপতি, টাঙ্গাইলের শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে অন্যতম যুগ্ম সম্পাদক করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। রােজগার্ডেনের সম্মেলনে প্রায় ৩০০ প্রতিনিধি উপস্থিত ছিল। সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী । শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক এ সম্মেলনে সংক্ষিপ্ত ভাষণ প্রদান করেন। উক্ত সম্মেলনে শামসুল হক পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ এবং জনগণের প্রত্যাশা ইত্যাদি বিষয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। মাওলানা ভাসানীকে সর্বসম্মতিক্রমে নবগঠিত রাজনৈতিক দলটির সভাপতি নির্বাচিত করা হয়েছিল। সম্মেলনে উপস্থিত নেতৃবৃন্দের পরামর্শক্রমে সভাপতি ৪০ সদস্যবিশিষ্ট একটি অর্গানাইজিং কমিটির নাম ঘােষণা করেন।

১. আওয়ামী লীগের কার্যক্রম 

পাকিস্তানকে আওয়ামী মুসলিম লীগ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করা এবং দেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার সাধনের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে । নবগঠিত দলটি লক্ষ্য অর্জনের জন্য ১২ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। এর মধ্যে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠান, বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া, পাটশিল্পকে জাতীয়করণ এবং ক্ষতিপূরণ প্রদান না করে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করার দাবি বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য ছিল। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী মুসলিম লীগ বিরােধী দলের ভূমিকা পালন করে।



২. আওয়ামী লীগে রক্ষণশীল-প্রগতিশীল দ্বন্দ্ব

আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রগতিশীল তরুণদের উদ্যোগ ও ইচ্ছায় প্রতিষ্ঠিত হলেও এতে যথারীতি রক্ষণশীল একটি গ্রুপ যােগদান করে। তারা মুসলিম লীগের মতাে গতানুগতিক ধারায় রাজনীতি করার পক্ষে মত দেন। কিন্তু প্রগতিশীল অংশ সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, পুঁজিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরােধী গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতি প্রবর্তনের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। এ কারণে মুসলিম লীগ ভেঙ্গে আওয়ামী লীগ করা হলেও রক্ষণশীল-প্রগতিশীলদের দ্বন্দ্ব অব্যাহত থাকে।

৩. আওয়ামী মুসলিম লীগ নামকরণের কারণ 

আওয়ামী মুসলিম লীগের পরিবর্তে আওয়ামী লীগ নামকরণের পক্ষে ছিলেন ওয়ার্কার্স এপের তরুণ নেতা-কর্মীগণ। তারা সংগঠনকে ধর্মনিরপেক্ষ করার পক্ষপাতি ছিলেন। তবে রক্ষণশীলগণ মুসলিম শব্দ রাখার ব্যাপারে অনড় ছিলেন। তবে মাওলানা ভাসানীর ভাবনা ছিল বাস্তবসম্মত এবং বুদ্ধিদ্বিপ্ত । তিনি প্রগতিশীলদের বােঝাতে সক্ষম হলেন, জনগণকে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করার জন্য মুসলিম শব্দযুক্ত বিরােধী দল থাকা প্রয়ােজন। তার যুক্তির গভীরতা বুঝতে পেরে সকলে নতুন পাটির নাম আওয়ামী মুসলিম লীগ করার পক্ষে মতামত দেন।

৪ আওয়ামী মুসলিম লীগের আন্দোলন 

পূর্ব পাকিস্তানে যেমন তেমনি পশ্চিম পাকিস্তানেও আওয়ামী মুসলিম লীগ বিরােধী দলের ভূমিকায় সমানভাবে অবতীর্ণ হয় এবং সরকারের নানা অন্যায় উদ্যোগ ও পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সােচ্চার আন্দোলন শুরু করে দল গঠনের প্রথম বছরে আওয়ামী মুসলিম লীগ পাকিস্তান গণপরিষদের উত্থাপিত মূলনীতি কমিটির রিপাের্টের বিরােধিতা করে প্রথম আন্দোলন শুরু করে। এ ধারাতে ৩০ জনুয়ারি ১৯৫২ সালে যে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় তাতে আওয়ামী মুসলিম লীগের এবং এর ছাত্র সংগঠন মুসলিম ছাত্রলীগের অবিস্মরণীয় অবদান লক্ষ করা যায়। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী মুসলিম লীগ যুক্তফ্রন্ট গঠনে ব্যাপক উদ্যোগী ভূমিকা পালন করে।

৫. আওয়ামী লীগ নাম চূড়ান্তকরণ

প্রতিষ্ঠার শুরুতেই প্রগতিশীল ঘরানার তরুণ নেতা-কর্মীদের পরিকল্পনা ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। কিন্তু শুরুর বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে তা সম্ভব ছিল না। কিন্তু প্রগতিশীল ঘরানার তরুণগণ হতােদ্যম হওয়ার পক্ষপাতি ছিলেন না। তারা এ লক্ষ অটুট রাখেন এবং পরবর্তী কাউন্সিলে দলের নাম পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাই ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৫৫ সালে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে আওয়ামী মুসলিম লীগের ‘মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে দলের নাম চূড়ান্তভাবে ‘আওয়ামী লীগ রাখা হয়। এভাবে দলটি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষর প্রাণের সংগঠনে পরিণত হয়।



৬. একক বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ 

মুসলিম প্রধান অঞ্চল হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তান হিন্দুদের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল কংগ্রেস ও হিন্দু তফশিলি সম্প্রদায়গুলাের রাজনৈতিক দলগুলাের বিকাশ সম্ভব ছিল না। কমিউনিস্ট ও সমাজতান্ত্রিক ঘরানার দলগুলাে চীন-রাশিয়া বিভাজনে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল এবং সেগুলো কখনােই গণমানুষের আস্থা অর্জন করতে পারে নি। মুসলিম লীগের নির্যাতন, দুঃশাসন ও ওয়াদা ভঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের সব মানুষ মুসলিম লীগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করে। ফলে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের পতন, এরপর সামরিক শাসন এবং শাসকের নতুন দল কনভেনশন মুসলিম লীগও পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রিয় হতে পারে নি বরং আইয়ুববিরােধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আওয়ামী লীগ অচিরেই পূর্ব পাকিস্তানের একক রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির হাজার বছরের ললিত স্বপ্নের রূপকার হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপট রচিত হয়ে যায় ।

আরো পড়তে পারেনঃ পাকিস্তানের রাজনীতিতে বিরােধী দলগুলাের গঠন এবং কার্যক্রম বিশ্লেষণ কর

উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে দলটিতে শেখ মুজিবুর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন। অবশেষে সােহরাওয়ার্দীর ইন্তেকালে দলটিকে একাই টেনে তােলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এ দলটি সবসময় বাংলার আন্দোলন সংগ্রামে অনন্য ভূমিকা রেখেছে। স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি, সংবিধান প্রণয়ন ও গণতন্ত্রের উত্তরণে দলটির ভূমিকা ছিল অনন্য।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ১