OrdinaryITPostAd

পাকিস্তানের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের ভূমিকা আলােচনা কর।

 


ভূমিকা: পাকিস্তানের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের ভূমিকা ব্যাপক। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ,স্বতন্ত্র বাঙালি জাতিসত্তা গঠন, পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রেও দলটি একক ও অনন্য কৃতিত্বের দাবিদার। পাকিস্তান রাষ্ট্রে আওয়ামী লীগের অ্যুদয় ঘটে প্রধান বিরােধী দল হিসেবে।

পাকিস্তানের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের ভূমিকা

 নিম্নে পাকিস্তান শাসনামলে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের আলােচনা করা হলাে-



১. পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি থেকে মুক্তিযুদ্ধ 

পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশে এ দলের শাখা থাকলেও এট ছিল পূর্ব পাকিস্তন ভিত্তিক একটি রাজনৈতিক দল। প্রথম থেকেই দলটি বাঙালিদের স্বার্থকে সামনে রেখে দলের কর্মসূচি প্রণয়ন করে। আওয়ামী লীগের প্রথম ঘােষণাপত্রে যে ১২ দফা কর্মসূচি ছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন। এ কারণে বলা যায়, সূচনা থেকেই দলটি ছিল বাঙালি স্বার্থের প্রতিভূ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্যন্ত ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট গঠন, ৫৬-৫৮ সাল পর্যন্ত সরকার পরিচালনা, ৫৮ এর সামরিক শাসনবিরােধী আন্দোলন, ৬৬ এর ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅ্যুথান, ৭১ এর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা এবং সর্বোপরি বিরােধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল।

আরো পড়তে পারেনঃ- আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে আলােচনা কর।

২. ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনে আওয়ামী লীগ 

ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিল। পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন ভাষার প্রশ্নে জিন্নাহসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দকে সমর্থন জানালে মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশ যারা পরবর্তীকলে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তারা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান কারাবন্দি অবস্থায় ভাষার দাবিতে আমরণ অনশন করেন এবং কারাগারে থেকে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পরামর্শও তিনি নিয়েছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৫৪ সালের ২১ দফায় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি যুক্ত করার ক্ষেত্রেও দলটি অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেন।



৩. ১৯৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট গঠন

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠন, এর নেতৃত্ব দান এবং নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে ধরাশয়ী করার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের ভূমিকা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৫৩ সালেই আওয়ামী লীগ যুক্তফ্রন্ট গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক ২১ দফা প্রণীত হয়েছিল আওয়ামী লীগের ১২ দফা কর্মসূচির আলােকে আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রাপ্ত ২২৩টি আসনের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৪৩টি আসন পেয়েছিল। যুক্তফ্রন্টের মধ্যে আওয়ামী লীগই ছিল সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল।

৪. পূর্ব বাংলায় সরকার গঠন 

১৯৫৬-৫৮ সাল সময়ে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দু’বছরের মতাে পূর্ব বাংলায় ক্ষমতাসীন থাকে। একই সময়ের মধ্যে, কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিনের জন্য মােট ৩ বার আতাউর রহমান খান ক্ষমতা হারান এবং পুনরায় সরকার গঠন করতে সমর্থ হন।

৫. পূর্ব বাংলায় ক্ষমতা থাকাকালে আওয়ামী লীগের গৃহীত পদক্ষেপ 

আওয়ামী লীগ সরকারের গৃহীত অন্যান্য পদক্ষেপের মধ্যে ছিল-

ক সীমান্তে চোরাচালান বিরােধী ক্লোজড ডাের অপারেশন’ চালানাে।

খ. ভূমিহীন কৃষকদের জন্য টেস্ট রিলিফের ব্যবস্থা।

গ, যথানিয়মে উপনির্বাচন অনুষ্ঠান (এ সময়ে ৭টি শূন্য আসনে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়)

ঘ, ভাষা আন্দোলনের শহিদদের পরিবারকে আর্থক সাহায্য দান।

ঙ, ২১ ফেব্রুয়ারিকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘােষণা।

চ, সরকারি উদ্যোগে ১ বৈশাখ বাংলা নববর্ষ উদযাপন।

ছ, আলিয়া মাদরাসার স্থায়ী ভবন নির্মাণ।

জ, ময়মনসিংহে পশু চিকিৎসা কলেজ স্থাপন।

ঝ, ফেঞ্চুগঞ্জ গ্যাস কারখানা এবং সাভার ডেইরি ফার্ম স্থাপন।

ঞ, চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নের জন্য ‘এফডিসি’ (Film Development Corporation) গঠন।



৬. আওয়ামী লীগে ভাঙন 

পূর্ব বাংলায় ক্ষমতা থাকাকালে আওয়ামী লীগের ভেতর ভাঙন এবং ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি) প্রতিষ্ঠা ছিল আওয়ামী লীগের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। তাছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর নানা ষড়যন্ত্র ছিলই। তাই সরকারের পক্ষে কাজ করা প্রায় দুরহ ছিল। তা সত্ত্বেও একই সময় ১৩ মাসব্যাপী কেন্দ্রে সােহওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সরকার ক্ষমতাসীন থাকায় পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক সরকারের পক্ষে উপরে উল্লিখিত কার্যাবলি সম্পাদনে তা সহায়ক হয়েছিল।

আরো পড়তে পারেনঃ- আওয়ামী মুসলিম লীগ এর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচির বিবরণ দাও।

৭. কেন্দ্র আওয়ামী লীগ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ 

পূর্ব বাংলার স্বার্থ রক্ষার্থে সােহরাওয়ার্দী সরকার কতিপয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। সেগুলাে ছিল এরূপ- ১. ‘সংখ্যাসাম্য নীতি’ অনুসরণে পাকিস্তানের উভয় অংশ থেকে সমানসংখ্যক সদস্য নিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। ২. পকিস্তানের ইতিহাসে এই প্রথম জাতীয় আইন পরিষদের অধিবেশন ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় (১৪ অক্টোবর, ১৯৫৬)। ৩. পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে আঞ্চলিক বৈষম্য দূর এবং পূর্ব বাংলার শিল্পায়নের জন্য কিছু পদক্ষেপ। গৃহীত হয়। ৪. এছাড়াও পূর্ব বাংলার উন্নয়নের জন্য আরাে কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়।

৮. আইয়ুব খানের সামরিক শাসনে আওয়ামী লীগ 

১৯৫৮-৬২ খ্রস্টাব্দে সামরিক শাসনকালে রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকায় দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কোনাে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে নি। সামরিক সরকারের দমনপীড়ন নীতির ফলে তখন অধিকাংশ নেতাকর্মী ছিলেন কারারুদ্ধ। তবে আওয়ামী লীগ অনুসারী ছাত্রসমাজ সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে সােচ্চার আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যায়।

৯. গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আওয়ামী লীগ 

১৯৬২ সালে সংবিধান প্রবর্তনের ফলে পুনরায় রাজনৈতিক কার্যকলাপ শুরু হলে আওয়ামী লীগ নেতাদের উদ্যোগে ১৯৬২ সালের ৫ অক্টোবর জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (NDF) প্রতিষ্ঠিত হয়। সােহরাওয়ার্দী ছিলেন এ ফ্রন্টের নেতৃত্বে।

১০. সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যু ও আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন 

সােহরাওয়ার্দী ১৯৬৩ সালে মৃত্যুবরণ করলে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট’ ভেঙে যায়, তবে ফ্রন্টভুক্ত দলসমূহ এ সময় পুনরুজ্জীবিত হতে থাকে। এ কারণে ১৯৬৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হয়।

১১. ৬ দফা আন্দোলন 

লাহােরে আহূত এক সাংবাদিক সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান অনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দফা প্রস্তাব’ কর্মসূচি প্রকাশ করেন। ছয় দফা ভিত্তিক এ কর্মসূচি ইতিহাসে ‘ঐতিহাসিক ছয় দফা’ নামে খ্যাত। ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিট এবং ১৯ মার্চ কাউন্সিল অধিবেশনে ছয় দফা কর্মসূচি অনুমোদন লাভ করে। এ ছয় দফা দাবি ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ।



১২. ৭০ এর নির্বাচন 

আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে সংরক্ষিত ১০টি মহিলা আসনসহ আওয়ামী লীগ ২৯৮টি আসন লাভ করে। এভাবে পূর্ব পাকিস্তানের একক শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের উত্থান ঘটে।

১৩. ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে অবদান

১৯৭১ সালের ২ মার্চ থেকে পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। তখন প্রশাসনের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতার লক্ষ্যে নীতি নির্ধারণী বক্তৃতা দেন। এমতাবস্থায় ইয়াহিয়া-মুজিব-ভুট্টো আলোচনা ব্যর্থ করে দিয়ে ইয়াহিয়া খান-ভুট্টো ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানে চলে যান। ইয়াহিয়ার নির্দেশে ঐ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী নিরীহ মানুষের ওপর ট্যাঙ্ক-অম্বশস্ত্র নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুকে ধানমণ্ডির বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘােষণা দিয়ে যান। এই ঘােষণার পর জনগণ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরােধ যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সাংগঠনিক রূপ লাভ করে। তারপর দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর নিকট পাকবাহিনী চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয় এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।

উপসংহারঃ পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, আওয়ামী লীগ ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে ছিল অগ্রনায়ক। পাকিস্তান প্রাদেশিক ও কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হয়ে বাংলার উন্নয়নে ৬ দফা, গণঅত্যুথান, ১৯৭০ এর নির্বাচন সর্বোপরি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ১