বাংলা ব্যাকরণে বাচ্যের ধারণা
বাংলা ব্যাকরণে বাচ্যের ধারণা নিয়ে বহু শিক্ষার্থীর মনে দ্বিধা আছে। প্রচলিত বইগুলিতে বাচ্যের আলোচনা বিভ্রান্তিকর। সেই বিভ্রান্তি দূর করে বাচ্যের সম্পূর্ণ ধারণা দেওয়ার উদ্দেশ্যে আজকের আলোচনা। বাচ্য চেনার উপায় ও বাচ্য পরিবর্তনের নিয়ম আলোচনা দুটিও পড়ে নিন।
বাচ্যের আলোচনার শুরুতেই আমরা তিনটি বাক্য নেবো।
১: আমি বই পড়েছি।
২: বই আমার দ্বারা পড়া হয়েছে।
৩: আমার বই-পড়া হয়েছে।
আরও পড়ুন: কারক
এই বাক্য তিনটির অর্থ একেবারে হুবহু এক, কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য আছে কেবল গঠনে। একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে গঠনের পার্থক্যটিও মূলত ক্রিয়াপদেই সীমাবদ্ধ। অন্য পদগুলি ততটা বদলায়নি। এখন আমরা বাক্য তিনটিকে উদ্দেশ্য ও বিধেয়ে ভেঙে দেখবো। বাক্যের উদ্দেশ্য ও বিধেয় সম্পর্কে জানার জন্য এখানে ক্লিক করুন।
১: আমি | বই পড়েছি। -- কর্তা 'আমি' এই বাক্যের উদ্দেশ্য
২: বই | আমার দ্বারা পড়া হয়েছে। -- কর্ম 'বই' বাক্যের উদ্দেশ্য রূপে ব্যবহৃত হয়েছে।
৩: আমার বই-পড়া | হয়েছে। -- 'আমার বই পড়া' অংশটি বাক্যের উদ্দেশ্য রূপে ব্যবহৃত হয়েছে।
সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি তিনটি বাক্যের অর্থ এক হলেও তিনটি বাক্যের উদ্দেশ্য আলাদা এবং তার ফলে বিধেয়রূপী সমাপিকা ক্রিয়াটিও আলাদা হয়ে গেছে। ১নং বাক্যে ক্রিয়াপদ 'পড়েছি'। ২ নং বাক্যে ক্রিয়াপদ 'পড়া হয়েছে' , ৩ নং বাক্যে ক্রিয়াপদ 'হয়েছে'। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো ২ নং বাক্যের 'পড়া' পদটি বিশেষণ কিন্তু ৩ নং বাক্যের 'পড়া' পদটি বিশেষ্য। এই বিষয়টি ভালো করে বুঝে নেওয়ার জন্য বিশেষ্য ও বিশেষণ অধ্যায় দুটি পড়ে নিতে হবে।
এবার মূল আলোচনায় আসি। আমাদের উপরোক্ত তিনটি উদাহরণের প্রথমটি কর্তৃবাচ্য, দ্বিতীয়টি কর্মবাচ্য এবং তৃতীয়টি ভাববাচ্যের উদাহরণ। এখন আমরা এই তিন বাচ্যের আলোচনা পৃথক ভাবে করবো এবং সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে বাচ্য কাকে বলে জেনে নেবো
বাচ্য কাকে বলে?
ক্রিয়াপদের প্রকাশভঙ্গির যে বৈচিত্র্যের কারণে বাক্যে কখনও কর্তার, কখনও কর্মের আবার কখনও ক্রিয়ার ভাবটির প্রাধান্য হয়, তাকে বাচ্য বলে।
তার মানে, বাচ্য হল ক্রিয়াপদের বিভিন্ন প্রকাশভঙ্গি।
বাচ্য কয় প্রকার?
প্রথাগত ধারণায় বাচ্য ৪ প্রকার ও আধুনিক ধারণায় বাচ্য ২ প্রকার। বাচ্যের আধুনিক ধারণার আলোচনা আমরা পরে করছি।
কর্তৃবাচ্য
যে বাচ্যে ক্রিয়াপদটি কর্তার অনুগামী হয় এবং কর্তাই বাক্যের উদ্দেশ্য রূপে ক্রিয়াপদ ও সমগ্র বাক্যকে নিয়ন্ত্রণ করে তাকে কর্তৃবাচ্য বলে।
ভাষায় কর্তৃবাচ্যের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি।
যেমন: ছেলেরা বল খেলছে। আমরা বই পড়বো। তুমি এখনই একবার এসো। রমা আজ রান্না করেছে। মা এখন বাড়িতে নেই। ছেলেটি অনেক বড়ো হয়েছে। ইত্যাদি।
এই বাক্যগুলিতে দেখা যাচ্ছে কর্তাই বাক্যকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ক্রিয়াপদটি কর্তার অনুগামী। কর্তা যে পুরুষের হবে, সমাপিকা ক্রিয়া সেই পুরুষের হবে।
কর্মবাচ্য
যে বাচ্যে ক্রিয়াপদটি কর্মের অনুগামী হয় এবং কর্মই বাক্যের উদ্দেশ্যের স্থানে ব'সে বাক্যকে নিয়ন্ত্রণ করে তাকে কর্মবাচ্য বলে।
যেমন: ১: ছেলেটি প্রহৃত হয়েছে। -- অর্থাৎ কেউ বা কারা ছেলেটিকে প্রহার করেছে। ছেলেটি আসলে কর্ম।
২: এই পুরস্কার আমাকে প্রদত্ত হয়েছ। -- এই বাক্যে দুটি কর্ম আছে। 'পুরস্কার' মুখ্য কর্ম ও 'আমাকে' গৌণ কর্ম। দুটি কর্মের মধ্যে একটি কর্ম (পুরস্কার) বাক্যের উদ্দেশ্য হয়েছে। অন্য কর্মটি বিধেয় অংশে স্থান পেয়েছে। ক্রিয়াপদ 'প্রদত্ত হয়েছে' পুরোটা। ক্রিয়াপদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন। তাহলে এই ধারণা আরও স্পষ্ট হবে।
৩: তার পর আমি পুলিশের দ্বারা ধৃত হলাম। -- এখানে লক্ষণীয় 'আমি' কর্মটি উত্তম পুরুষ, তাই ক্রিয়াপদ 'ধৃত হলাম' উত্তম পুরুষের অনুগামী হয়েছে। কর্মবাচ্যের সমাপিকা ক্রিয়াটি কর্মের পুরুষ অনুসারে গঠিত হয়। কর্মের পুরুষ বদলে গেলেই কর্মবাচ্যের ক্রিয়া বদলে যায়। কর্মবাচ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা গঠনের জন্য এই ব্লগের ধাতু অধ্যায় থেকে কর্মবাচ্যের ধাতু পড়ে নিতে হবে।
ভাববাচ্য
যে বাচ্যে ক্রিয়ার ভাবটিই প্রাধান্য পায়, ক্রিয়াপদটি কর্তা বা কর্মের অনুসারী হয় না, তাকে ভাববাচ্য বলে।
ভাববাচ্যের উদাহরণ
১: আমার খাওয়া হয়েছে।
২: তোমার খাওয়া হয়েছে।
৩: রামের খাওয়া হয়েছে।
এই তিনটি উদাহরণে দেখা যাচ্ছে কর্তা তিনটি আলাদা পুরুষের হলেও ক্রিয়াপদ প্রতি ক্ষেত্রেই প্রথম পুরুষের ক্রিয়া। কারণ 'খাওয়া' বিশেষ্যটি (ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য) বাক্যের উদ্দেশ্য রূপে কাজ করছে। 'খাওয়া' পদটি যেহেতু প্রথম পুরুষ, তাই প্রতি ক্ষেত্রে ক্রিয়াও প্রথম পুরুষের হয়েছে। মনে রাখতে হবে: ভাববাচ্যের সমাপিকা ক্রিয়া সব সময় প্রথম পুরুষের ক্রিয়া হয়।
ভাববাচ্যের আরও উদাহরণ
৪: আমাকে যেতে হবে।
৫: এবার ওঠা যাক।
৬: কোথায় যাওয়া হয়েছিলো?
৭: আমাদের পড়া হয়নি।
৮: তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
৯: এবার যাওয়া যেতে পারে।
১০: তোমার ভাত খাওয়া হয়েছে?
** একটি জরুরি তথ্য: কিছু কিছু বইয়ে লেখা আছে সকর্মক ক্রিয়ার ভাববাচ্য হয় না। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। অকর্মক ক্রিয়ার কর্মবাচ্য হয় না, এ কথা ঠিক কিন্তু সকর্মক ক্রিয়ার ভাববাচ্য হতে কোনো বাধা নেই। ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর 'ভাষাপ্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ' গ্রন্থে সকর্মক ক্রিয়ার ভাববাচ্যের উদাহরণ দিয়েছেন। উপরের ১০ নং উদাহরণটি সকর্মক ক্রিয়ার ভাববাচ্যের উদাহরণ।
ভাববাচ্যের শ্রেণিবিভাগ
ভাববাচ্য তিন প্রকারের হতে পারে।
১: গৌণকর্ম-কর্তা ভাববাচ্য: এই প্রকার ভাববাচ্যে কর্তায় 'কে' বা 'এ' বা 'য়' বিভক্তি যুক্ত হয়। কর্তাটিকে গৌণ কর্ম মনে হয়। 'কাকে' প্রশ্নের উত্তরে কর্তাকে পাওয়া যায়।
যেমন: আমাকে যেতে হবে। তোমাকে আসতে হবে। তোমায় খেতেই হবে।
এই প্রকার ভাববাচ্যে ইতে-অন্ত অসমাপিকা ক্রিয়া (যেমন যেতে, খেতে) বাক্যের উদ্দেশ্য স্থানে থাকে। এটিই ক্রিয়ার ভাব। ভাববাচ্যের উদ্দেশ্য-স্থানীয় এই অসমাপিকা আসলে বিশেষ্য পদ।
২: সম্বন্ধ-কর্তা ভাববাচ্য: এই ধরনের ভাববাচ্যে কর্তায় সম্বন্ধ পদের বিভক্তি 'র', 'এর', 'দের' যুক্ত হয়। কর্তাকে সম্বন্ধ পদ বলে মনে হয়। 'কার' প্রশ্নের উত্তরে কর্তা পাওয়া যায়।
যেমন: আমার যাওয়া হবে না। তোমার খাওয়া শেষ হলো না?
৩: লুপ্ত-কর্তা ভাববাচ্য: এই প্রকার ভাববাচ্যে কর্তা লোপ পায়।
যেমন: এবার যাওয়া যেতে পারে। এবার বলা হোক।
কর্মকর্তৃবাচ্য
অনেক সময় কর্মই বাক্যের কর্তা হয়ে ওঠে। তখন তাকে কর্মকর্তৃবাচ্য বলে। এই বাচ্যে কর্তার উল্লেখ থাকে না। ক্রিয়াটি কর্তৃবাচ্যের মতোই হয়। কর্মকর্তৃবাচ্য বিষয়ে বাংলা ব্যাকরণে বিতর্ক আছে। বিশেষত কেমন উদাহরণকে কর্মকর্তৃবাচ্য বলা যাবে তা নিয়ে বিভিন্ন লেখক ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। নিচে কর্মকর্তৃবাচ্যের প্রচলিত কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো।
কর্মকর্তৃবাচ্যের উদাহরণ:
শাঁখ বাজে। আলো জ্বলে উঠলো। বাস থামলো। ট্রেন চলছে। এই বাক্যগুলি কর্মকর্তৃবাচ্যের উদাহরণ।
কর্মবাচ্য ও ভাববাচ্যের পার্থক্য
বাক্যের মধ্যে কর্ম না থাকলে, অর্থাৎ ক্রিয়াটি অকর্মক হলে কর্মবাচ্য হয় না, শুধুমাত্র ভাববাচ্য হয়। কিন্তু কর্ম থাকলে তার দুই বাচ্যই হতে পারে। তখন কর্মবাচ্য ও ভাববাচ্যকে আলাদা করে চেনা অনেক সময় জটিল হয়ে যায়। কর্মবাচ্য ও ভাববাচ্যের পার্থক্য নির্ণয়ের একটি উপায় আছে। নিচে দুটি উদাহরণের সাহায্যে উপায়টি বোঝানোর চেষ্টা করলাম।
বইটি | আজকেই কেনা হয়েছে। - কর্মবাচ্য।
আমার ভাত খাওয়া | হয়েছে। - ভাববাচ্য।
উপরের দুটি বাক্যকে আমি উদ্দেশ্য ও বিধেয়ের মাঝে একটি বড় দাঁড়ি দিয়ে ভাগ করে দিয়েছি। এইবার বাক্য দুটি পড়ে দেখুন, ওই দাঁড়ির জায়গায় অল্প থামলে বাক্যটিকে স্বাভাবিক লাগছে কিনা। লাগছে তো? দেখুন: কর্মবাচ্যে কর্মের পর থামছি এবং ভাববাচ্যে ক্রিয়ার কাজটির পর থামছি। এটিই কর্মবাচ্য ও ভাববাচ্যের পার্থক্য নির্ণয়ের নিয়ম।
আধুনিক ধারণায় বাচ্যের শ্রেণিবিভাগ
আধুনিক ধারণায় বাংলা বাচ্যকে দু ভাগে ভাগ করা হয়েছে, কর্তা-বাচ্য ও ভাববাচ্য।
কর্তাবাচ্য দুই ভাগে বিভক্ত।
১: সম্পাদক কর্তাবাচ্য বা সাধক কর্তাবাচ্য
প্রকৃত কর্তাই যখন বাক্যে কর্তার স্থানে থাকে তখন তাকে সম্পাদক কর্তাবাচ্য বলে। অর্থাৎ প্রথাগত ধারণায় যা কর্তৃবাচ্য, আধুনিক ধারণায় তা-ই সম্পাদক কর্তাবাচ্য।
২: অসম্পাদক কর্তাবাচ্য বা সাধিত কর্তাবাচ্য
কর্ম যখন কর্তার স্থানে থাকে, তখন সেই বাচ্যকে অসম্পাদক কর্তাবাচ্য বলে। কর্ম প্রকৃত পক্ষে ক্রিয়ার সম্পাদক নয়, তাই এর এ রূপ নামকরণ হয়েছে। প্রথাগত ধারণার কর্মবাচ্য ও কর্মকর্তৃবাচ্য এই ভাগে পড়ে।
আধুনিক ধারণার ভাববাচ্য ও প্রথাগত ধারণার ভাববাচ্য একই। তাই এ বিষয়ে আলাদা করে এখানে কিছু বলা হলো না। প্রথাগত ধারণায় যে আলোচনা করা হয়েছে, তা যথেষ্ট।
নিচে প্রদত্ত লিংক থেকে বাচ্য চেনার উপায় অধ্যায়টি পড়ে নিলে বাচ্য সম্পর্কে আরও কিছু বিষয় জানা যাবে।
বাচ্যের মূল ধারণা
এই আলোচনাটি মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে। একবার বুঝতে পারলে বাচ্যের মূল ধারণাটি নিয়ে আর কোনো ধন্দ থাকবে না।
বাংলা বাচ্য বিষয়ে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অনেক বিভ্রান্তি। সত্যি কথা বলতে ব্যাকরণবিদদের মধ্যেও এ নিয়ে বিভ্রান্তি নেহাৎ কম নয়। বাচ্যের প্রথাগত ধারণা ও আধুনিক ধারণা, দুটি ধারণাই পাশাপাশি চলছে এই বিভ্রান্তির কারণেই। নয়তো একই বিষয়ে দুটি সমান্তরাল ধারণা ও সমান্তরাল পরিভাষা রচনার প্রয়োজন পড়তো না। ছাত্র-ছাত্রীদের বাধ্য হয়ে দুটি ধারণাই পড়তে হচ্ছে। তার কারণ, কোন ধারণাটি চূড়ান্ত, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে কে? সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরাও এই বিভ্রান্তির শিকার কিনা, তা কে বলবে? যাই হোক, একজন শিক্ষক হিসেবে আমার দায়িত্ব যে কোনো বিষয়কে যথাসম্ভব বাস্তবোপযোগী ও সহজবোধ্য আকারে শিক্ষার্থীদের কাছে উপস্থাপন করা। ইতিপূর্বে আমার ব্লগে 'বাচ্য চেনার উপায়' নামে একটি পোস্ট দিয়েছি। পোস্টটি শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছে, কিন্তু এই রকম শর্টকাট পদ্ধতিতে ব্যাকরণ শেখার কিছু সমস্যা আছে। তাই বাচ্যের বিস্তারিত আলোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। তাই পরবর্তী সময়ে এই পোস্টে বাচ্য সম্পর্কে যতটা সম্ভব বিস্তারিত আকারে আলোচনা করলাম।
বাচ্য আসলে কী?
বাচ্য নির্ণয়ের সময় যে কথাটি মাথায় রাখতে হবে, তা হল বাচ্য মানে ক্রিয়াপদের প্রকাশভঙ্গির বৈচিত্র্য। অর্থাৎ একটি ক্রিয়াকে বিভিন্ন ধরনের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করা যায়। এক-একটি ধরনকে বলে এক-একটি বাচ্য।
ক্রিয়াপদ বলতে এখানে সমাপিকা ক্রিয়া বুঝতে হবে। অসমাপিকা ক্রিয়ার সঙ্গে বাচ্যের কোনো যোগ নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সমাপিকা ক্রিয়ার প্রকাশ কখন বদলে যায়? কেনই বা বদলে যায়?
আমরা জানি, সমাপিকা ক্রিয়া হল বাক্যের বিধেয় এবং এই বিধেয়ের রূপ নির্ভর করে বাক্যের উদ্দেশ্যের উপর। এখন বাক্যের মধ্যে কোন পদটি উদ্দেশ্য হতে পারে? স্বাভাবিক নিয়মে ক্রিয়াপদের কর্তাই বাক্যের উদ্দেশ্য হয়। কর্তা কি সব সময় বাক্যের উদ্দেশ্য হতে পারে? না, এটি স্বাভাবিক নিয়ম। কর্তা ছাড়া কর্মও বাক্যের উদ্দেশ্য হতে পারে। কর্তা যদি উদ্দেশ্য হয়, তাহলে বিধেয়-রূপী সমাপিকা ক্রিয়া কর্তার শাসন মেনে চলবে। আবার কর্ম যদি উদ্দেশ্য হয়ে যায়, তাহলে সে কর্মেরই শাসন মানবে। শাসন মানা বলতে উদ্দেশ্য অনুযায়ী পুরুষবাচক ক্রিয়াবিভক্তি গ্রহণ করা। উদ্দেশ্য যদি উত্তম পুরুষ হয়, ক্রিয়া তবে উত্তম পুরুষের ক্রিয়াবিভক্তি(বিভক্তি অধ্যায় দ্রষ্টব্য) গ্রহণ করবে এবং এই ভাবেই সে উত্তম পুরুষের প্রতি নিজের আনুগত্য জানান দেবে। উদাহরণ দিয়ে বোঝাই:
যেমন: "আমি পুস্তক পাঠ করি।" এখানে উদ্দেশ্য 'আমি' উত্তম পুরুষ। সমাপিকা ক্রিয়া 'পাঠ করি'। দেখা যাচ্ছে ক্রিয়াটির শেষে উত্তম পুরুষের ক্রিয়াবিভক্তি 'ই' রয়েছে। ক্রিয়াটিকে ভাঙলে পাচ্ছি: পাঠ করি = √পাঠ কর্ + ই (√পাঠ কর্ - একটি যুক্ত ধাতু)। সুতরাং ওই 'ই'-বিভক্তির নিশানটি মাথায় দিয়ে ক্রিয়াপদ জানান দিচ্ছে যে, সে উদ্দেশ্য উত্তম পুরুষের বশংবদ।
এবার এই বাক্যটিকে একটু ফের-বদল করে পুস্তককে কর্তা বা উদ্দেশ্যের স্থানে বসিয়ে যদি বলি : "পুস্তক আমার দ্বারা পঠিত হয়।" তাহলে কী ঘটল? ক্রিয়াটির চেহারা বদলে হয়ে গেল 'পঠিত হয়'। এই বদল দু ভাবে সম্পন্ন হল:
প্রথমত: ক্রিয়াটির পুরুষ-বিভক্তি বদলে গেল, কারণ এখন উদ্দেশ্য 'পুস্তক' প্রথম পুরুষ, তাই ক্রিয়াকে প্রথম পুরুষের নিশান 'এ' বিভক্তি মাথায় নিতে হয়েছে। পঠিত হয় = √পঠিত হ + এ(এ>য় হয়েছে য়-শ্রুতির ফলে)।
দ্বিতীয়ত: ক্রিয়াটির ধাতুও বদলে গেছে। আগে ছিল √পাঠ কর্ ধাতু, এখন হয়েছে √পঠিত হ ধাতু। এমনটা কেন হলো? কারণ আগে ক্রিয়ার কাজটা করছিলো কর্তা, এখনও আসলে কর্তাই কাজটা করছে, কিন্তু বাক্যের প্রকাশভঙ্গিটা এমনই, যেন মনে হচ্ছে কর্তা কাজ করছে না, কাজ করছে কর্ম (পুস্তক) এবং কর্তা 'আমি' তাকে সাহায্য করছে। তাহলে আমার কাজ যদি 'পাঠ করা' হয়, তাহলে পুস্তকের কাজ কী? পুস্তকের কাজ 'পঠিত হওয়া'। পুস্তক জড়বস্তু, সে নিজে পাঠ করতে পারে না, কিন্তু অন্যের দ্বারা পঠিত হতে তো পারে! তাই পুস্তক যখন কর্তা তথা উদ্দেশ্যের জায়গা নিয়ে নিলো, তখন ধাতুটিকেও এমন ভাবে বদলাতে হবে যাতে পরিবর্তিত নতুন ক্রিয়ার কাজটি পুস্তকের কাজ হয়ে ওঠে। পুস্তকের কাজ 'পঠিত হওয়া', তার ধাতু 'পঠিত হ'।
উপরের দুটি উদাহরণের মধ্যে প্রথমটি কর্তৃবাচ্যের ও দ্বিতীয়টি কর্মবাচ্যের। এবার বাকি রইলো ভাববাচ্য ও কর্মকর্তৃবাচ্য। আগে বুঝবো ভাববাচ্য।
ভাববাচ্যে যেটা হয়, তা হলো কর্তা বা কর্ম কাউকেই উদ্দেশ্য বা কর্তার স্থানে রাখা হয় না। তার পরিবর্তে ক্রিয়াপদটি থেকেই একটি বিশেষ্য বা বিশেষ্য-স্থানীয় অসমাপিকা ক্রিয়া নিষ্কাশন করা হয় এবং তাকেই বাক্যের উদ্দেশ্য করে দেওয়া হয়। ওই নিষ্কাশিত পদটির মধ্যেই মূল ক্রিয়ার ভাবটি নিহিত থাকে। একটি নতুন উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটি বোঝাবো।
কর্তৃবাচ্য: আমি যাই।
ভাববাচ্য: আমার যাওয়া হয় / আমাকে যেতে হয়।
একটি বাক্যেরই দুটি ভাববাচ্য রূপ দেখা যাচ্ছে। প্রথম রূপের 'যাওয়া' ও দ্বিতীয় রূপের 'যেতে' পদদুটি আসলে ওই নিষ্কাশিত পদ। 'যাওয়া' সরাসরি ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য এবং 'যেতে' বিশেষ্যধর্মী অসমাপিকা। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হল: এই ক্রিয়াজাত পদদুটি বাক্যের উদ্দেশ্য হয়ে গেছে এবং 'হ'-ধাতুজ ক্রিয়া 'হয়' দিয়ে বিধেয় গঠন করা হয়েছে। এখানে মজার বিষয় হল, ক্রিয়াপদটি নিজেই বিশেষ্যের আকার ধারণ করে কর্তা সেজে বসেছে এবং বিধেয়ের ভূমিকা পালন করার জন্য বাইরে থেকে একটি ক্রিয়াকে(হয়) ডেকে এনেছে। কিন্তু ডাকলেই সে আসবে কেন? আসবে, কারণ আসার যুক্তি আছে। কী সেই যুক্তি?
"আমি যাই।"- এই বাক্যটির অর্থ হিসেবে আমরা যদি বলি: "যাওয়া কাজটি হয়।" তাহলে কি খুব একটা ভুল বলা হলো? ভুল নয়, ঠিকই বলা হলো, কিন্তু প্রশ্ন আসবে "যাওয়া তো হয়, কিন্তু কার যাওয়া?" আমি বলবো, "আমার যাওয়া।"
অর্থাৎ 'যাওয়া' হল উদ্দেশ্য, 'আমার' হল উদ্দেশ্যের প্রসারক এবং 'হয়' ক্রিয়াটি বিধেয়। দ্বিতীয় বাক্যটিতে 'যেতে' উদ্দেশ্য, 'আমাকে' উদ্দেশ্যের প্রসারক এবং 'হয়' বিধেয়।
এতদূর পর্যন্ত আলোচনা থেকে কর্তৃবাচ্য, কর্মবাচ্য ও ভাববাচ্যের ধারণাটি স্পষ্ট হয়েছে আশা করা যায়। এরপর আসি কর্মকর্তৃবাচ্যের ধারণায়। কর্মকর্তৃবাচ্য আসলে গঠনের দিক থেকে কর্তৃবাচ্য ও ভাবের দিক থেকে কর্মবাচ্য। এই বাচ্যে কর্তা থাকে না, মনে হয় কর্মই কর্তা। মনে রাখতে হবে, কর্মবাচ্যেও কর্ম কর্তার জায়গা দখল করে নেয়। তবু কর্মবাচ্যে ধাতুটি আলাদা হয় বলে কর্মকে সরাসরি কর্তা বলে মনে হয় না। অপরদিকে কর্মকর্তৃবাচ্যের ক্রিয়াটি কর্তৃবাচ্যের মতোই হয়। যেমন: "শাঁখ বাজছে।" শাঁখ আসলে বাজছে না, বাদিত হচ্ছে, কিন্তু তা না বলে আমরা বললাম শাঁখ নিজেই বাজছে। 'বাজছে' ক্রিয়াটি কিন্তু কর্তৃবাচ্যেরই ক্রিয়া, অথচ শাঁখ প্রকৃত কর্তা নয়। এই হল কর্মকর্তৃবাচ্য।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url