Hsc (BOU) History বাংলায় ফকির ও সন্ন্যাসী আন্দোলন
আঠার শতকের শেষার্ধে বাংলায় ফকির ও সন্ন্যাসী আন্দোলন ছিল বৃটিশ বিরোধী একটি সশস্ত্র সংগ্রাম। এই সময় ফকির নামে পরিচিত মুসলমান সুফি সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী নামে পরিচিত
মানুষ সমাজে ছিল। এই সংসার ত্যাগী সম্প্রদায়ের মানুষ দলবদ্ধ হয়ে ঘুরে বেড়াতো। ধর্মের কথা বলতো। সাধারণ মানুষ তাদের ভক্তি করত। মানুষের দেয়া তাদের চাল, ডাল সব্জিতে তাদেরা জীবন নির্বাহ হতো। ধর্মীয় উৎসব বা তীর্থস্থান দর্শন উপলক্ষ্যে এসকল ফকির সন্ন্যাসীরা সারা বছর একস্থান হতে অন্যস্থানে ঘুরে বেড়াতেন এবং পথে নিরাপত্তার জন্য তারা নানা ধরনের হাল্কা অস্ত্র সাথে বহন করতেন।
প্রকৃত পক্ষে বাংলায় ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পূর্ব পর্যন্ত এরা স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতেন। জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সাধারণ কৃষকের হয়ে মাঝে মাঝে তারা রুখে দাঁড়াতেন। জমিদাররা তাই ফকির সন্ন্যাসীদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের ক্ষেপিয়ে তুলতো। এর প্রতিক্রিয়ায় ইংরেজ সরকার তাদের স্বাধীন চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে।
[ বি:দ্র: নমুনা উত্তর দাতা: nullblogger ©সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত nullblogger.com
তীর্থস্থান দর্শনের উপর করারোপ করে। ভিক্ষা ও মুষ্টি সংগ্রহকে বে-আইনী ঘোষণা করে। পরিকল্পনা করে ফকির সন্ন্যাসীদের ডাকাত-দস্যু বলে মানুষের কাছে হেয় করে তুলতো। এসব কারণে ফকির-সন্ন্যাসীরা ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। তাই এক পর্যায়ে ফকির ও সন্ন্যাসীরা ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। তাদের এ তৎপরতা ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় যা প্রায় চার দশক পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
বিদ্রোহের গতি
ফকির ও সন্ন্যাসীরা সরকারি কুঠি, জমিদারদের কাছারী ও নায়েব গোমস্তার বাড়ি আক্রমণ করতো। লাঠি, বর্শা, তরবারী ও গাদা বন্দুক ছিল তাদের অস্ত্রশস্ত্র। চাকুরী হারা অনেক সৈনিক এবং দুর্দশাগ্রস্থ বহু কৃষক তাদের সংগ্রামে যোগ দেয়। ফকিরগণ বাংলার অধিবাসী হলেও তাদের আন্দোলনের প্রধান নেতারা ছিলেন অবাঙালি। বিদ্রোহী ফকিরদের নেতা ছিলেন মজনু শাহ এবং সন্ন্যাসীদের নেতা ছিলেন ভবানী পাঠক।
১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায় সন্ন্যাসীরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রথম সংগ্রাম শুরু করে। এরপর একদল ফকির ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে বাকেরগঞ্জে কোম্পানির ফ্যাক্টরিতে হামলা করে। তাদের আক্রমণের মুখে কুঠির প্রধান মি. লিস্টার পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। ফকির দল বিনা বাঁধায় কুঠি দখল করে লুণ্ঠন করে। সে বছরেই সন্ন্যাসীরা রাজশাহীতে কোম্পানির ফ্যাক্টরিতে হানা দেয়। ফ্যাক্টরির প্রধান মি. বেনেটকে তারা বন্দি করে এবং পাটনায় নিয়ে গিয়ে তাকে হত্যা করে। উত্তর বঙ্গে ফকির-সন্ন্যাসী তৎপরতা দমনের জন্য ক্যাপ্টন ডি. ম্যাকেঞ্জির নেতৃত্বে ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে রংপুরে এক অভিযান প্রেরিত হয়। সেই অভিযানের সময় ইংরেজ পক্ষের লেফটেন্যান্ট কিথ এবং তাদের অনেক সৈন্য নিহত হয়।
১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে ফকির মজনু শাহ সমগ্র উত্তরবঙ্গে ইংরেজ বিরোধী তৎপরতা গড়ে তোলেন। পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য কোম্পানিকে রংপুর ও দিনাজপুরে অতিরিক্ত সৈন্য প্রেরণ করতে হয়। ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে মজনু শাহ দুই হাজার সশস্ত্র অনুগামীসহ রাজশাহী আক্রমণ করেন এবং কোম্পানির রাজস্ব অফিস লুণ্ঠন করেন। পরের বছর অন্য এক সংঘর্ষে সন্ন্যাসীদের হাতে ক্যাপ্টেন টমাস পরাজিত ও নিহত হন। মজনু শাহের সাথে ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ সৈন্যধ্যক্ষ রবার্টসনের বাহিনীর এক তীব্র সংঘর্ষ হয়। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের শেষে মজনু শাহ পালিয়ে যান। এরপরেও উত্তর বঙ্গ এবং ময়মনসিংহে ইংরেজ বাহিনীর সাথে মজনু শাহ-এর কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়েছিল।
ঐসব সংঘর্ষে মজনু শাহের রণকৌশল ছিল গেরিলা কায়দায় আক্রমণ ও নিরাপদে পলায়ন করা। কিন্তু কোম্পানির পক্ষে কখনো তাঁকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করা সম্ভব হয় নি। ফকির মজনু শাহ ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর ফকির দলের নেতৃত্ব দেন মুসা শাহ, সোবহান শাহ, চেরাগ আলী শাহ, করিম শাহ, মাদার বক্স প্রমুখ ফকিরগণ। এঁরাও কয়েক বছর কোম্পানিকে ব্যতিব্যস্ত রাখেন। কিন্তু নেতৃত্বের কোন্দল, সংঘবদ্ধতার অভাব, সরকারী বাহিনীর শক্তিবৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে ফকিরদের প্রতিরোধ আন্দোলন ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তাঁরা চূড়ান্তভাবে পরাজিত হন।
সন্ন্যাসী বিদ্রোহের নেতা ভবানী পাঠকের সঙ্গে ফকির দলনেতা মজনু শাহের যোগাযোগ ছিল। রংপুর, রাজশাহী ও বগুড়া অঞ্চল ছিল তাঁর আশ্রয়স্থল। ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে লেফটেন্যান্ট ব্রেনানের অধীনে একদল বৃটিশ সৈন্যের আক্রমণে ভবানী পাঠক ও তাঁর দুই সহকারী নিহত হন এবং অপর ৪২ জন বন্দি হয়। দেবি চৌধুরাণী নামের একজন ছোট জমিদারের সঙ্গে ভবানী পাঠকের যোগযোগ ছিল বলে এক সরকারী নথিতে উল্লেখ রয়েছে। ব্রিটিশ সরকারের ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের ফলে ফকির সন্ন্যাসী আন্দোলন এক সময় স্তিমিত হয়ে গেলেও এতে বৃটিশ বিরোধী জনমত গড়ে উঠে।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url