এলোমেলো গল্পকথা;বিক্রমাদিত্যের বারান্দা
আমাদের
বাড়ির বারান্দার আমার প্রথম যে স্মৃতিটা আছে, তার সঙ্গে এখনকার বারান্দার
কোনও মিল নেই। প্রথম স্মৃতির বারান্দা ঢালাইবিহীন, নিচু। সদরঘরের চৌকাঠে
বসে সে বারান্দায় পা রাখলে আমার তিন বছরের হাঁটু চিবুকে এসে ঠেকত। দুটি
হলুদ রং করা পিলার ঠেকনা দিয়ে রাখত টালির ঢালু চাল। একটা কংক্রিটের
স্ল্যাবের বেঞ্চি ছিল দেওয়ালের সঙ্গে সাঁটা। মান্যগণ্যরা সেখানে বসতেন। আর
তুচ্ছরা মাটিতে বসত, কিংবা দাঁড়াত হলুদ পিলারে হেলান দিয়ে, কিংবা চিবুকে
হাঁটু ঠেকিয়ে। একটাই মোটে সিঁড়ির ধাপ ছিল, সেটা ধরে নেমে সরু ইটের পথ চলে
যেত সবুজ গাছের বেড়ার বাঁশে দড়ির ফাঁস পরানো বাখারির সিংদরজা পর্যন্ত।
ওই বারান্দায় বসা আমার প্রথম স্মৃতিটা আনন্দের। আমার বয়স
তখন চারেরও কম, কারণ চারের একটা স্মৃতি আমার মনে আছে যেটা ডেফিনিটলি
আনন্দের নয়। যাই হোক, প্রথমে আনন্দের স্মৃতিটার কথা বলি। আনন্দের বুঝতে
পারছি, কারণ স্মৃতিব্যাপী হলুদ রং। সম্ভবত বেলাটা ছিল অপরাহ্ন এবং আমাদের
বারান্দায় পোস্ট-লাঞ্চ আড্ডার সেশন চলছিল। হয় ঠাকুমার বন্ধু, নয় পিসির
বন্ধু, নয় কাকুর বন্ধু কেউ না কেউ গজল্লা করত ও বারান্দায়। সেদিনও করছিল।
খুব হাসাহাসি হচ্ছিল। সে সব হাসাহাসিতে অংশগ্রহণ করতে না পারলেও, এই
জমায়েতে উপস্থিত থাকার গৌরবের আঁচ এখনও পোহাতে পারি।
উল্লেখ করলাম যখন দ্বিতীয় স্মৃতিটার কথাও বলে যাই। আমি
এটায় ঠিক বারান্দায় নেই, তখনও জানালার গোবরাটে এঁটে যাই, ওখানেই বসে আছি।
বসে বসে ঢুলছি। একটু আগেই মা এসে তুলেছেন ঘুম থেকে। রোজই তোলেন, কিন্তু
সেদিন তখনও জানালার বাইরে ঘুরঘুটি অন্ধকার, মায়ের চোখে জল, মুখ ফোলা, গলা
ধরা। বারান্দা ওই শেষ রাতেও ভিড়ে থিকথিক। অন্যদিনের থেকে বেশি। ভিড়ের
মধ্যমণি হয়ে, মালাটালা পরে, সাদা চাদর চাপা দিয়ে, চোখ বুজে, চোখে তুলসীপাতা
চাপা দিয়ে শুয়ে আছেন আমার ঠাকুরদা।
বাই দ্য ওয়ে, বাড়ি গিয়ে শুনলাম আমার এক আত্মীয়ের বাড়া
প্রতিবেশীর বাবা মারা গেছেন এর মধ্যে, রাত এগারোটার সময় তাঁকে শ্মশানে নিয়ে
যাওয়ার লোক পাওয়া যায়নি। সঙ্গে গেছে শুধু বাড়ির চারজন। জাজ করতে গিয়ে থেমে
গেছি। আমিও ছিলাম, না থাকাদের দলে।
সে বারান্দার সঙ্গে কোনও মিল নেই এ বারান্দার। সবথেকে
প্রকট অমিলটা হচ্ছে যে এখন ও বারান্দায় কেউ আড্ডা মারতে আসে না। চেহারাও
বদলেছে প্রচুর। উঁচু, পাকা ছাদ, নিচের অর্ধাংশে নিরেট দেওয়ালের ওপর গ্রিল।
সে গ্রিলে সর্বক্ষণ তালা ঝোলে। এই তালাচাবি ব্যাপারটায় আমার রীতিমত
অস্বস্তি হত ব্যাপারটা শুরু হওয়ার প্রথম তিনচার বছর পর্যন্ত। কীই বা আছে
আমাদের বাড়িতে নেওয়ার মতো, কেই বা নেবে? আমাদের বাড়িতে এতদিন চুরি হত খালি
ফুল। চুরি হত বলা ভুল, চুরির ব্যর্থ চেষ্টা হত। আমাদের পাড়ার ডেজিগনেটেড
ফুলচোর শিবু, অন প্রিন্সিপল পাড়ার বাড়ির ফুল চুরি করত না। পাশের পাড়ার এবং
দূরদূরান্তের (অনেকে মর্নিং ওয়াক করতে করতে কোন্নগর, হিন্দমোটর থেকেও হেঁটে
হেঁটে চলে আসতেন বিনা অনুমতিতে ফুল পাড়তে পাড়তে, তেমনও গল্প শোনা যায়)
অভিজ্ঞ চোরেরাও জেনে গিয়েছিলেন, যে আমাদের বাড়িতে ফুল চুরি করা যায় না।
গাছে হাত ছোঁয়ানোমাত্র অন্ধকার বাড়ির ভেতর থেকে চিৎকার আসে, কে রে?? আমাদের
বাড়ির গাছে হাত ছোঁয়ালেও, পাশের তিনচারটে বাড়ির গাছে হাত ছোঁয়ালেও। তখন
চিৎকারটা চোরের উদ্দেশে না হয়ে ভেসে যায় গাছের মালিকদের উদ্দেশে, ও বলাই, ও
মীরা, ও রত্না, তোমাদের সব ফুল নিয়া গেল। একটা সময়ের পর উক্ত মালিকেরা
জোড়হস্তে পিটিশন দিয়েছিল ঠাকুমার কাছে, যে ফুল যাক মাসিমা, আপনি সাড়ে
তিনটের সময় চেঁচাবেন না। সে গল্প আগেও করেছি।
এখন শুনলাম, চুরিডাকাতি বেড়েছে। ছিঁচকে চুরিই, তবু চুরি।
আমাদের বারান্দায় একটা থাক থাক জুতোর র্যাক আছে। বারান্দার গ্রিল দিয়ে হাত
ঢোকালে ওপরের র্যাকে রাখা জুতো নাগালে পাওয়া যায়। বাবার একজোড়া প্রায়
নতুন আর মায়ের একজোড়া প্রায় এক্সপায়ারি ডেটের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া জুতো
উধাও হওয়ার পর এখন ওই দুটো তাকে আর জুতো রাখা হয় না। এ বছর আরও একটা চুরি
হয়েছে বাড়িতে, যাতে বাবা জুতো হারানোর থেকে যুগপৎ বেশি কাতর ও কুপিত
হয়েছেন। চুরি হয়েছে তিনখানা পুরুষ্টু কাঁঠাল। সপ্তাহখানেক আগেই বাবা
ভিডিওকলে ঘুরে ঘুরে দেখিয়েছিলেন কেমন নধর হয়ে উঠেছে তিনজন। বাবার আফসোস আরও
বেশি এইজন্য যে তার আগেরদিনই কথা হয়েছিল যে এবার কাঁঠাল নামিয়ে নেওয়া
দরকার। বাবার ভোট নামিয়ে নেওয়ার পক্ষে ছিল। বাকিরা আড়মোড়া ভেঙে জানিয়েছিল
যে এখনও কিছুদিন আরেকটু পাকতে অ্যালাউ করা যেতে পারে। পরদিনই এই কাণ্ড।
বাবা দাবি করছেন তিনি জানেন কে চোর। আমাকে তাঁর সন্দেহের কথা ব্যক্ত করেছেন
তিনি। শুনে আমার চিত্ত চমৎকার। সন্দেহ মূলক না অমূলক সেটা গৌণ, মুখ্য কথা
হল যে সন্দেহভাজন পাড়ার লোক। আমি অনেক করে বুঝিয়েছি যেন বাবা তাঁর সন্দেহের
কথা নিজের মনেই রাখেন, কারও কাছে প্রকাশ করতে না যান।
কথা হল, এই সব চুরিচামারি বাড়ল কেন। আমার একটা থিওরি হল যে
বাড়ল তালাচাবির জন্য। তালাচাবি দেওয়া রইল বলে বারান্দায় কেউ এসে আড্ডা
জমাতে পারল না, আর ভরদুপুরবেলা বারান্দা খালি পড়ে রইল বলে চোরদের সাহস বেড়ে
গেল। এ তত্ত্বের দু'ধরনের প্রতিযুক্তি হতে পারে। এক, যখন আড্ডা বসত তখন কি
চুরি হত না? হত। যদিও শোনা গল্প, অবান্তরে বলেছি। সে অনেক বছর আগের কথা।
সম্ভবতঃ আমার জন্মের আগে। অনেকে বলে তখন নাকি আড্ডা আরও বেশি জমত। আমার
জন্মের পর তো তবু লোকে আড্ডা থামিয়ে নাইতেখাইতে বাড়ি যেত, তখন নাকি তাও যেত
না। বেলা হয়ে গেলে এর ওর বাড়িতেই খেয়ে নিত যা রান্না হয়েছে। যাই হোক, এই
পরিস্থিতিতে আমাদের বাগানের জামা শুকোনোর দড়িতে ঝুলছিল সেজকাকুর একখানা
টুকটুকে লাল গেঞ্জি (তখনও টি শার্ট বলত না লোকে), আর একজন চোর এসে সে
গেঞ্জি নিয়ে হাঁটা।
রাদার, দৌড়। ঘটনাটা আবিষ্কৃত হয়েছিল তৎক্ষণাৎ। কারণ তখন
আরও একটা জিনিস ছিল আমাদের পাড়ায়। পার্সোন্যাস স্পেসের সম্পূর্ণ
অনুপস্থিতি। সকলেই যে যার জানালা, দরজা, ঘুলঘুলি দিয়ে একে অপরের বাড়ির দিকে
নজর রাখত। সে রকম কোনও একজন নজরদার চেঁচিয়ে উঠলেন। "ওরে
তপন/চন্দন/খোকন/শিখা/বুড়ো/মেসোমশাই/কাকিমা, তোমাদের গেঞ্জি চুরি হয়ে গেল"
তখনকার আরও একটা বৈশিষ্ট্য, এখন যেমন তিনজন লোকের রিষড়ায় একটা পৈতৃক বাড়ি
আর কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট থাকে, মিনিমাম, তখন অত্যন্ত ছোট ছোট বাড়িতে
ঠাসাঠাসি করে অনেক লোক থাকত। আরও অমিল, এখন যেমন যার বাড়ির লোককে ডাকা
হচ্ছে সেও অনেকসময় কথা বলতে বিরক্ত লাগছে বলে সাড়া না দিয়ে ঘাপটি মেরে বসে
থাকে, তখন এক বাড়ির লোককে ডাকাডাকি করলে চারপাশের সব বাড়ির লোক সাড়া দিত।
তখনও দিয়েছিল। তারপর সবাই মিলে সাইকেলটাইকেল নিয়ে সে চোরের ধাওয়া করে প্রায়
স্টেশনের কাছাকাছি পৌঁছে চোরকে ধরে, দুই থাবড়া মেরে গেঞ্জি নিয়ে বিজয়গর্বে
বাড়ি ফিরেছিল। ।
দু'ধরনের প্রতিযুক্তি বলেছিলাম না? দ্বিতীয় রকম মনে পড়ছে না আর। কাজেই চোরের গল্প দিয়েই এ প্রসঙ্গ শেষ। ।
এখন আমাদের চাবিতালা দেওয়া, ফ্যান চলা, উঁচু বারান্দায় কেউ
আড্ডা মারে না। সবাই একা একা বসে থাকে। একসময় ঠাকুমা বসে থাকতেন, তার পর
বাবামা দুজন মিলে বসতেন, এখন বাবা একা বসে থাকেন। বসে বসে দেখেন চারপাশ। এই
ক'দিন অবশ্য দেখার মত একটা ব্যাপার ঘটেছে বাড়ির সামনে। জলের পাইপ বসাতে
গিয়ে মিউনিসিপ্যালিটি মারাত্মক মজা কইর্যা থুইসে। ।
এই মজা কইর্যা থুইসের গল্পটাও বলি, শুনুন। এটা আমার
শ্বশুরবাড়ির গল্প। মায়ের দিকের। আমার বিশ্বাস বা বায়াস যাই বলুন না কেন,
সেটা হল যে পারিবারিক স্মৃতিচারণের মজা বাঙাল ভাষায় যেমন জমে, পৃথিবীর অন্য
কোনও ভাষায় জমে না। অনেকে বলতে পারেন যে এই মজার পেছনে আছে ভাষাটার প্রতি
অসম্মান। সে যুক্তি আমার ক্ষেত্রে ধোপে টিকবে না। আমি কাঠবাঙাল, কাজেই
বাঙাল ভাষা নিয়ে হাসা আমার রাজনৈতিক ভ্রান্তি নয়, জন্মগত অধিকার। মানে আপনি
যদি ঘটি হন এবং আপনার বাঙাল বন্ধুকে "বল তো ব্যালকনি?" বলে উত্তরে
"বেলকনি" আর "বল তো বেলঘরিয়া?" র উত্তরে "ব্যালঘরিয়া" শুনে পুনঃপুনঃ
রোমাঞ্চিত হন তাহলে আপনি নরকের কীট। কিন্তু আমরা যদি একজোট হয়ে সেই
পূর্বপুরুষের হেনস্থার এই গল্প পুনঃপুনঃ শুনে পেট চেপে গড়াগড়ি খাই সেটা
অ্যালাউড। মায়েদের ছোটবেলায় একজন অংকের শিক্ষক আসতেন বাড়ির বাচ্চাদের
পড়াতে। একেবারে গেঁড়ি বাচ্চা না, কারণ একটা লেভেলের জ্ঞানবুদ্ধি তাদের
হয়েছিল যা দিয়ে তারা বুঝতে পারত কোথায় মাস্টারমশাই হোঁচট খাচ্ছেন। যেমন ধরা
যাক কে সি নাগের অনুশীলনীর শেষদিকের অংকগুলো। কিন্তু মাস্টারমশাই হওয়ার
জ্বালা, চট করে হার স্বীকার করা যায় না। তখন তিনি মুচকি হেসে বলতেন, এই
অংকটায় অ্যাকখান মজা কইর্যা থুইসে। সেই থেকে মজা কইর্যা থুইসেটা মায়েদের
বাড়ির লব্জে পরিণত হয়েছে। মাথাচুলকোনো কোনও কিছুই উদ্ভব ঘটলেই সবাই বলে
ওঠে, মজা কইর্যা থুইসে। ।
এ রকম আরেকটা গল্প আছে মায়েদের বাড়ির যার শিরোনাম 'গরিবের
ফিলিংসটা দিব কেডা'। সেটা অন্য কোনওদিন মনে করাবেন বলব। এ পোস্টটা অলরেডি
আশাতীত অসংলগ্ন হয়েছে। ।
যাই হোক, আমাদের মিউনিসিপ্যালিটিও আমাদের সঙ্গে মারাত্মক
মজা কইর্যা থুইসে, জলের পাইপ বসানোর নামে রিষড়ার রেললাইনের গোটা এপারটা
খুঁড়ে দিয়ে গেছে। আমি যাওয়ার তিনদিন পর্যন্ত আমার বাড়ির সামনেটুকু অক্ষত
ছিল, খালি নীল রঙের বোম্বেটে জলের পাইপগুলো ইতিউতি জড়ো হয়ে নীরব হুমকি
দিচ্ছিল, চতুর্থদিন সকালে উঠে দেখি এই কাণ্ড।
মজাটা আরও বেশি হয়েছে মিউনিসিপ্যালিটির অসামান্য
টাইমিং-এর কারণে। জুনের শেষ, আর এ বছর প্রায় প্লাবন হওয়ার মত বৃষ্টি হচ্ছ
বাড়িতে। সে বৃষ্টির পোস্ট লিখব আলাদা করে। মোদ্দা কথা, জল জমে এই গর্ত
সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, আর যদিও তিনটে কঞ্চিতে প্লাস্টিকের
সতর্কতামূলক ফিতে পেঁচিয়ে রঙজ্বলা গোলাপি গামছা ওড়ানো ছিল, জায়গাটা আক্ষরিক
অর্থেই মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছিল।
আমার বাবা নাওয়াখাওয়া আর ঘুমের সময়টুকু বাদ দিয়ে বারান্দায়
ডিউটি দিচ্ছিলেন আর ক্ষণে ক্ষণে "বাঁদিক চেপে!" ডানদিক চেপে!" "ওখানে
গর্ত!" "এখানে গর্ত!" চিৎকার করে পথচারী, সাইকেলচারী, বাইকচারীদের
মধুসূদনদাদা হয়ে উঠেছিলেন। এবং যে নিষ্ঠার সঙ্গে বাবা কাজটা করছিলেন, আমার
সন্দেহ হচ্ছিল যে গোটাটা শুকনো কর্তব্য নয়।
আমার বাবার চরিত্রের এই দিকটার সঙ্গে বাংলাসাহিত্যের এক
উল্লেখযোগ্য চরিত্র 'চ'-র মিল আছে। এই চ-র "...চরিত্রের আরেকটা দিক প্রকাশ
পেয়েছিল পাটনা স্টেশনের কাছাকাছি এসে। ...সেবার গাড়িটা ছিল অমৃতসর মেল।
পাটনা পৌঁছবে ভোর পাঁচটায়।...গাড়ি স্টেশনে পৌঁছবার ঠিক তিন মিনিট আগে
হঠাৎ ঘ্যাঁচ করে থেমে গেল। ব্যাপার কী? লাইনের উপর দিয়ে ল্যাম্প ও টর্চের
ছুটোছুটি দেখে মনে হল কোনও গোলমাল বেধেছে। শেষটায় গার্ড এসে বললেন একটা
বুড়ো নাকি লাইন পার হতে গিয়ে এঞ্জিনে কাটা পড়েছে। তার লাশ সরালেই গাড়ি
চলবে। চ খবরটা পাওয়ামাত্র ভারী উত্তেজিত হয়ে স্লিপিং সুট পরেই অন্ধকারে
নেমে চলে গেলেন ব্যাপারটা চাক্ষুষ দেখে আসতে।"
চ-এর পুরো নাম বলবেন আপনারা। চ বন্ধুবান্ধবের কাছে সে
নামের বদলে কী নামে পরিচিত ছিলেন এবং তিনি কী ধরনের চা খেতেন বলতে পারলে
কুর্নিশ।
দুর্ঘটনার দরকার পড়ত না, গাড়ি থেমেছে এবং আমার বাবা গাড়ি
থেকে নামেননি এ ঘটনা আমার স্মৃতিতে নেই। আমার মায়ের একটা নিয়মিত কাজ ছিল
দূরপাল্লার যাত্রায় বিরতি শেষে বাস ছাড়ার আগের মুহূর্তে গিয়ে কন্ডাকটর
ড্রাইভারকে খবর দেওয়া যে মায়ের স্বামী বাসে নেই, কোথায় মা জানেন না।
ট্রেনের চেন টানার সাহস মা দেখাননি কোনওদিন, বাবার বারণও ছিল। দরকার হলে
তিনি নাকি গার্ডের কামরায় উঠে পড়বেন ঠিক। নিয়মিত ট্রেন ছাড়ার দুই, পাঁচ
এমনকী পনেরো মিনিট পরেও বাবা কামরায় এসে উপস্থিত হতেন, হাতে সাধারণত ধরা
থাকত কচুরি, জিলিপি বা ওই জাতীয় মহার্ঘ কিছু, স্টেশন থেকে যা সংগ্রহ করতে
গিয়ে বাবা আরেকটু হলে ট্রেন মিস করে যাচ্ছিলেন।
যাই হোক। বাবারও প্... ইস দেখেছেন, আরেকটু হলে চ-এর পুরো
নামটা বলে ফেলছিলাম, কিছু হলে দৌড়ে দেখতে যাওয়ার ব্যামো আছে। এই যে বাড়ির
সামনে মৃত্যুফাঁদ খোঁড়া হল, বাবা মাস্ক পরে সারাদিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
দেখলেন। সবার সঙ্গে কথা বললেন, বিরাট বেলচা লাগানো হলুদ গাড়িটার টঙে
ড্রাইভারের সিটে যে বসে আছে আর যে কোদাল হাতে পাতালে নেমে গিয়ে খুঁড়ছে,
কাউকে বঞ্চিত করলেন না, কন্ট্রাক্টরের নাম, পাইপের কোম্পানি থেকে শুরু করে
টোটাল সাপ্লাই চেন সম্পর্কে যা যা জানার সব জেনে ফেললেন। তারপর বসলেন
বারান্দায় মধুসূদনগিরি করতে।
আর অমনি বারান্দাটার একটা বৈশিষ্ট্য যা এতদিন আমি বুকের ভেতর জেনেছিলাম কিন্তু সক্রিয়ভাবে ভাবিনি কখনও, প্রকট হল।
ঠাকুমা দাবি করতেন যে ওই বারান্দায় বসে তিনি মানুষের মন
দেখতে পান। কার বাড়িতে চেঁচিয়ে ঝগড়া না বাধলেও তলে তলে বনছে না, কার ওপরে
ফাঁট এদিকে ব্যাংকে ঢুঁ ঢুঁ, কে পাড়ায় অষ্টমীর রাতে সেরা দম্পতি
প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট প্রাইজ জিতছে এবং শেওড়াফুলিতে আরেকটা সংসার করছে
চুটিয়ে - সব ঠাকুমা বারান্দায় বসে জেনে ফেলতেন এবং বিশ্বাসী লোকদের
জানাতেন। বিশ্বাসীদের লিস্টের টপে ছিলাম আমি। গোড়াতে খুব আমোদ লাগত শুনতে,
তারপর লায়েক হলাম, পার্সোন্যাল স্পেসটেস নিয়ে বেশ একটা নীতিধ্বজী ভাব জাগল
মনে, তখন রাগ করতাম। রাগ শুধু করে লাভ নেই, কাজেই দেখাতামও। করছে তো করছে,
তোমার কী? তাছাড়া ওই শেওড়াফুলির ব্যাপারটা যে স্রেফ কেচ্ছা সে নিয়েও
স্যাংগুইন ছিলাম মনে মনে এবং যারা এইরকম সেনসিটিভ ব্যাপার নিয়ে গুজব ছড়ায়
তাদের রুচির লেভেল দেখে শিউরে শিউরে উঠতাম। মাসছয়েক পর কী ঘটল সে আর বানান
করে বলে দিতে হবে না আশা করি। কাকিমা ক্লাবঘরে কেঁদে এসে পড়লেন, মিটিং বসল,
কাকু অধোবদনে এসে হাজিরা দিলেন, অল্প চোখও ভিজেছিল নাকি, প্রত্যক্ষদর্শীরা
বয়ান দিল। আমি ছ'মাস আগের ঠাকুমাকে দেওয়া নীতিশিক্ষার ক্লাসের লজ্জা বুকে
নিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম, মুচকি হাসার বদলে ঠাকুমা, "হালাগোর লজ্জাও নাই" বলে
আরেকটা মশার প্রাণ নিয়ে ক্রমে চুড়ো হয়ে ওঠা তার ভাইবেরাদরের মৃতদেহের ঢিপির
ওপর নিক্ষেপ করলেন।
বাবাও দাবি করেন আজকাল, বারান্দায় বসেই তিনি জেনে যান কার
বাড়িতে কোভিড হয়েছে। আমাকে জানান। (বাবার ডিফেন্সে, বাবা শুধু আমাকেই
বলেছেন, ফোন তুলে থানায় খবর দেননি। সেটা অন্য বারান্দায় বসা অন্য কেউ
দিয়েছে এবং পুলিস এসেছে। এবং কোভিড যে চেপে যাওয়া হচ্ছিল তাও ধরা পড়েছে)
মোদ্দা কথা, দেখেশুনে আমার বিশ্বাস জন্মেছে যে আমাদের বারান্দাটার মধ্যে
একটা বিক্রমাদিত্যের সিংহাসনের চরিত্র আছে, যা বসে থাকা ব্যক্তিকে
স্বাভাবিকের থেকে দীর্ঘ ও গভীর দৃষ্টি প্রদান করে। বারান্দায় বসে বাবা
আজকাল নাকি মানুষের মনও পড়তে পারছেন নির্ভুল। কয়েকদিন আগেই ফোনে বললেন,
সোনা, ওই যে অ ছিল মনে আছে? মিনিট পাঁচেক মাথা চুলকে অ-কে চিহ্নিত করলাম।
বাবা বললেন, বাইক কিনে অ-র খুব দেমাক হয়েছে। যতদিন সাইকেল চড়ে যাতায়াত করত
উইদাউট ফেল বাবা বারান্দায় বসে থাকলে হাত নেড়ে 'মেজদাআআ' হাঁক পেড়ে যেত।
এখন নাকি নতুন বাইকে চড়ে ফুলস্পিডে ডাঁটের মাথায় বেরিয়ে যায়। ডাক তো দূর,
বাবাকে দেখে হাত পর্যন্ত নাড়ে না।
আমি বললাম, হয়তো দেখ তাড়ায় থাকে। বাবা বললেন, তাড়া?
সাইকেলের বদলে বাইক চড়ে যাতায়াত করলে তো উল্টে সময় বেঁচে যাওয়ার কথা! সেই
লজিকে হাত নাড়ার সঙ্গে সঙ্গে থেমে দুয়েকটা কথা বলাও উচিত। তখন স্বীকার
করিনি, কিন্তু এটা আমারও চোখে পড়েছে আগেও। যে যত দ্রুতগামী বাহনের মালিক
হয়, যুক্তির আগামাথা গোল্লায় দিয়ে তার সময় তত কম পড়ে। আমাদের ওই গলি
রাস্তায় বাইকগুলো যে রকেটের বেগে যাতায়াত করে, তা বাইকচারী, পথচারী, সাইকেল
ও রিকশাচারীদের পক্ষে বিপজ্জনক। বেড়ালছানাগুলোর কথা না হয় তুললামই না।
গর্ত খোঁড়া হয়ে যাওয়ার পর একদিন ভেতরের ঘরে শুয়ে শুয়ে
ক্যান্ডি ক্রাশ খেলছি, বাবা বিজয়গর্বে এসে জানালেন যে এক্ষুনি একটা মজা হল।
জানা গেল, উক্ত অ, যিনি বাইক কিনে ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন, একটু আগে বাইক
সহ গর্তে পড়ে গেছিলেন। আমার একটা বিশ্রী সন্দেহ হল এবং তার ছাপ পড়ল
মুখেচোখে। ।
বাবা আহত ভঙ্গি করে বললেন, বাকিদের যা করেন অ-কে তার থেকে বেশি করেছেন, বেশি দূর থেকে করেছেন। বাইকের আওয়াজে শুনতে পেলে তো।
যাই হোক, সে বাইক তো সোজা কাদায় ঢুকে গেছে। বাবা দৌড়ে
গেছেন। অ ততক্ষণে বাইক নিয়ে ব্যর্থ টানাটানি করছে। নির্ঘাত মনে মনে ভাবছে
সাইকেল থাকলে এখন কত সহজে পরিত্রাণ পাওয়া যেত। বাবা গিয়ে বললেন, তুই ওদিক
থেকে ঠেল আমি এদিক থেকে টানছি। সে হাঁ হাঁ করে উঠে বলল, তুমি পারবে না
মেজদা, ছেড়ে দাও। বাবার এখন মাথার চুল সব সাদা হয়ে গেছে। তাছাড়া আজকাল
মাঝেমাঝেই শুনি বাবা কাল রাতে স্রেফ দুধ খই খেয়ে শুয়ে পড়েছেন কাজেই
চেহারাটাও বেশ রোগার দিকে গেছে, যৌবনের দূতেরা যে হেলাছেদ্দা করবে তাতে
আশ্চর্য নেই।
বাবা বললেন, আহা চেষ্টা করেই দেখি না।
যুগল এফর্টে সহজেই বাইক গর্ত থেকে উঠে এল। বাবা বললেন, এইদিক দিয়ে আস্তে করে চলে যা।
পরদিন বাজার থেকে পোস্ত নিয়ে বাবা খুব ভালো মুডে ফিরলেন।
দোষটা আমার। কী খাবি প্রশ্নের উত্তরে ফস করে আলুপোস্ত বলে দিয়েছি, এদিকে
বাড়িতে পোস্ত নেই। বাইরে ঘনিয়ে এসেছে কালো মেঘ, বাবা বারণ না শুনে ছাতা
মাথায় চলে গেলেন বাজার। বাজারের মধ্যে দিয়ে নাকি বাইকে করে অ যাচ্ছিল।
কালকের পরেও শিক্ষা হয়নি, সমান ঊর্ধ্বশ্বাসে, সমান ডাঁটের মাথায়। তবে লজ্জা
মনে হয় হয়েছে। বাবাকে দেখে নাকি বাইক স্লো করে হাত নেড়েছে।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url