OrdinaryITPostAd

মুসলিম লীগের অবক্ষয় এবং এর পুনর্গঠনে সমস্যা সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা কর।

 ভূমিকা : মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষায় রাজনৈতিক মুখপাত্র হিসেবে ব্রিটিশ শাসনামলে মুসলিম লীগ এর জন্ম হয়। স্বাধীনতা লাভের পর এ মুসলিম লীগ তাদের সেই প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্দেশ্য ভুলে যায়। তখন মুসলিম লীগের অবক্ষয় পরিলক্ষিত হয়। এটি হয়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তানিদের মুখপাত্র । যার কারণে পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ নেতাদের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিম লীগ নেতাদের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। এরই ফলে মুসলিম লীগ বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়।

আরো পড়তে পারেনঃ- মুসলিম লীগের শাসন ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির সংগ্রাম আলোচনা কর।




মুসলিম লীগের অবক্ষয় :

ভারত বিভক্তির পর মুসলিম লীগে নানা ধরনের অবক্ষয় পরিলক্ষিত হয় নিচে তা বিস্তারিত আলােচনা করা হলাে-

১. অসাম্প্রদায়িক দল করার প্রস্তাব নাচক

স্বাধীনতা লাভের পর ডিসেম্বর ১৯৪৭ সালে করাচিতে মুসলিম লীগের প্রথম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিলে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ বিভক্ত করে পাকিস্তান মুসলিম লীগ গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তখন সােহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগকে অসাম্প্রদায়িক দলে পরিণত করার প্রস্তাব উত্থাপন করলে তা নাকচ হয়ে যায়।

২. নতুন গঠনতন্ত্র ও নিয়ন্ত্রণ 

ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে কাউন্সিলে মুসলিম লীগের নতুন গঠনতন্ত্র অনুমােদিত হয় এর আগে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে আহ্বায়ক করে গঠনতন্ত্র কমিটি গঠিত হয়। মুসলিম লীগের নতুন গঠনতন্ত্র অনুযায়ী মন্ত্রীদের সাংগঠনিক পদ গ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৯ সালে অনুষ্ঠিত ৩য় কাউন্সিলে চৌধুরী খালিকুজ্জামান প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন। জিন্নাহর জীবদশায় মুসলিম লীগ তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। তার মৃত্যুর পর লিয়াকত আলী খান দলের নিয়ন্ত্রণ ভার গ্রহণ করেন। কাউন্সিলের মােট ৪৬৫ সদস্যদের মধ্যে ১৮০টি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারণ করা হয় এবং মুসলিম লীগে নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্ত বন্ধ করে দেয়া হয়। এভাবে দলের নিয়ন্ত্রণ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর হাতে চলে যায়



৩. নেতাদের স্বেচ্ছাচারিতা, কর্মীদের ক্ষোভ 

৮ অক্টোবর ১৯৫০ সালে মুসলিম লীগের কাউন্সিলে দলের গঠনতন্ত্র সংশােধন করে প্রধানমন্ত্রীকে পদাধিকারবলে সভাপতি নিয়ােগ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এতে দলে গণতন্ত্র চর্চা রহিত হয়। সরকার পুরােপুরি মুসলিম লীগকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। এভাবে নেতাগণ স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠলে প্রগতিশীল কর্মীদের মধ্যে প্রবল ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। নেতাগণ এসব ক্ষোভ উপেক্ষা করলে দলে ভাঙন অনিবার্য হয়ে পড়ে।

৪. নতুন দলের উদ্ভব ও প্রভাব 

মুসলিম লীগ নেতাদের স্বেচ্ছাচারিতার জবাব পশ্চিম পাকিস্তানে মানকী শরীফের পীরের নেতৃত্বে মে, ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ নামে নতুন দল প্রতিষ্ঠিত হয়। ২৩ জুন ১৯৪৯ সালে পূর্ব বাংলায় মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ। পশ্চিম পাকিস্তানে মানকী শরীফের পীরের আওয়ামী লীগ তেমন কোনাে প্রভাব বিস্তার করতে না পারলেও পূর্ব বাংলায় এর ভীষণ প্রভাব তৈরি হয়। মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলায় দুর্বল হয়ে যায়। ১৯৪৯ সালে প্রবীণ মুসলিম লীগ নেতা খুররম খান পন্নী টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে তরুণ আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রার্থী শামসুল হকের নিকট পরাজয়বরণ করেন। যা কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সরকারকে অত্যন্ত আতঙ্কগ্রস্ত করে তােলে। তারা পূর্ববাংলার ৩৪টি আসনে উপনির্বাচন বন্ধ রাখেন এবং ১৯৫১ সালে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন মুলতবি ঘােষণা করেন।

৫. পূর্ব বাংলা মুসলিম লীগে দ্বন্দ্ব ও দলত্যাগ 

শাসকগােষ্ঠীর স্বৈরাচারী মনােভাব মুসলিম লীগ দলের মধ্যে ভীষণ ক্ষোভের সৃষ্টি করে এতে বিক্ষুদ্ধ নেতা-কর্মীদের দল ত্যাগ করে ঢালাওভাবে আওয়ামী মুসলিম লীগে যােগদান করতে থাকেন। যার কারণে মুসলিম লীগ দুর্বল হয়ে যায়। দলে অন্তর্দ্বন্দ্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। নুরুল আমিন মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে হামিদুল হক চৌধুরী একটি ভিন্ন উপদল তৈরি করে মুখ্যমন্ত্রীকে পদে পদে বিপদে ফেলার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। দলের অন্তর্থ এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, জানুয়ারি, ১৯৫১ সালে মাওলানা আকরম খাঁ সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন।



৬. পূর্ব বাংলায় নুরুল আমিন ও মুসলিম লীগের পতন 

খাজা নাজিম উদ্দিনের আশীর্বাদধন্য নুরুল আমিন মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর ২৩ আগস্ট, ১৯৫২ সালে অনুষ্ঠিত পূর্ব বাংলা মুসলিম লীগের প্রথম কাউন্সিলে তিনি দলের সভাপতিও নিযুক্ত হন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে অদক্ষতা এবং ভাষা আন্দোলনের মতাে জাতীয় ইস্যুতে দেশের মানুষের আবেগের বিরুদ্ধে দাঁড়ানাের কারণে তিনি অত্যন্ত অগ্রহণযোগ্য এবং ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়ে পড়েছিলেন। মুসলিম লীগের ভাবমূর্তি তার পক্ষে পূর্ব বাংলায় উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। যার প্রভাবে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগের শােচনীয় পরাজয় ঘটে এবং পূর্ব বাংলা থেকে দলটির নির্বাসন নিশ্চিত হয়ে পড়ে। নির্বাচনের পর ৩ জানুয়ারি ১৯৫৫ সালে নুরুল আমিন সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫ সালে পূর্ব বাংলা মুসলিম লীগের কাউন্সিলে বেশির ভাগ শীর্ষ নেতা পদত্যাগ করেন। দলের মুখপাত্র হিসেবে প্রকাশিত দৈনিক বাংলা দলের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের ঘােষণা দেয়। এভাবে পূর্ব বাংলায় নুরুল আমিন ও মুসলিম লীগের পতনের ষােলকলা পূর্ণ হয়।

৭. কেন্দ্রে মুসলিম লীগের বিপর্যয় 

বাংলায় বিপর্যয়ের সাথে সাথে দ্বিতীয় গণপরিষদে মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় এবং কৃষক-শ্রমিক পার্টির সঙ্গে কোয়ালিশন করতে বাধ্য হয়। ২৮-২৯ জানুয়ারি, ১৯৫৬ সালের কাউন্সিলে আব্দুর রব নিসতার পার্টির সভাপতি নিযুক্ত হন। পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ডা. খান সাহেবের সঙ্গে নিসতার সংঘাতে জড়িয়ে যায় । এ সুযােগে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা মুসলিম লীগ থেকে ২২ জন গণপরিষদ সদস্য নিয়ে মে, ১৯৫৬ সালে রিপাবলিকান পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। যার ফলে ১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৬ সালে চৌধুরী মুহাম্মদ আলী কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে। এভাবে ১৯৪৭ সালের পর মুসলিম লীগ কেন্দ্রীয় ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়। এরপর ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির আগে আই. আই. চন্দ্ৰীগড়ের নেতৃত্বে কেবল ২ মাসের জন্য দলটি সরকার গঠনে সক্ষম হয়। এভাবে পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী দলটি প্রথম দশকের মধ্যেই দেশটির কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সকল ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়ে।

মুসলিম লীগের পুনর্গঠন সমস্যা :

বিভিন্ন কারণে মুসলিম লীগের পুনর্গঠন সমস্যা সমাধান করা যায় নি, তন্মধ্যে অন্যতমকয়েকটি কারণ আলােচনা করা হলাে-

১.  মুসলিম লীগ দলের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও গণবিরােধী কার্যকলাপ 

মুসলিম লীগ পাকিস্তানের সবচাইতে পুরনাে রাজনৈতিক দল। ১৯০৬ সালে ঢাকার নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগের জন্ম হয়। ১৯১৩ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত মুসলিম লীগ অবিভক্ত ভারতের মধ্যবিত্ত মুসলমান শ্রেণিকে আকৃষ্ট করে। পাকিস্তান ইস্যুর প্রশ্নে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পর মুসলিম লীগ দলের অভ্যন্তরীণ কাঠামাের পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এই দলের সদস্যপদ লাভের সুযােগও সংকুচিত করা হয়। তাছাড়া ক্ষমতা লাভকারী মুসলিম লীগ দলের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও গণবিরােধী কার্যকলাপের ফলে অনেক মুসলিম লীগ সদস্যই নিদারুণ অসন্তোষের সাথে দল ত্যাগ করে অন্য দল গঠনে আগ্রহী হয়।

২. মুসলিম লীগে বিভক্তি 

পাকিস্তানে ১৯৫৮-৬২ সাল পর্যন্ত প্রথম দফা সামরিক শাসনের পর ১৯৬২ সালে দলীয় রাজনীতি শুরু হয়। এ সময় আইয়ুব খান একটি দল গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সে মােতাবেক মুসলিম লীগের সাবেক সভাপতি চৌধুরী খালিকুজ্জামান ৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৬২ সালে করাচিতে মুসলিম লীগের কনভেনশন আহ্বান করেন। এর মাধ্যমে কনভেনশন মুসলিম লীগ গঠিত হয়। আইয়ুব খান এর সভাপতি নির্বাচিত হন। পূর্ব পাকিস্তানের ফজলুল কাদের চৌধুরী, সবুর খান, মােনেম খান এতে যােগদান করেন। কনভেনশন মুসলিম লীগ গঠনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ২৭ নভেম্বর, ১৯৬২ সালে ঢাকায় কাউন্সিলে কাউন্সিল মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। খাজা নাজিম উদ্দিন এর সভাপতি নিযুক্ত হন। খাজা খয়ের উদ্দিন ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের নেতা। আইয়ুববিরােধী আন্দোলনে এ দলটি যােগ দেয়। আইয়ুবের বিরুদ্ধে ১৯৬৫ সালের নির্বাচনে দলটি ফাতিমা জিন্নাহকে সমর্থন করে। কিন্তু ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের অখণ্ডতার দোহাই দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। ১০ এপ্রিল, ১৯৭১ সালে খাজা খয়ের উদ্দিন শান্তিকমিটি নামে পাকবাহিনীর যে সহযােগী দল গঠিত হয় তার আহ্বায়ক নিযুক্ত হন। বিভক্তির সময় মুসলিম লীগে কাইয়ুমপন্থি আরেকটি উপদল তৈরি হয়। অবশ্য বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে এ দলটিও প্রকাশ্যে বিরােধিতা এবং পাকবাহিনীকে সহযােগিতা করেছিল।



৩. মুসলিম লীগ আমলে গঠিত দলসমূহ 

পূর্ব বাংলা সহ প্রদেশগুলাের প্রতি অবিচার, শাসনতন্ত্র প্রণয়নে দীর্ঘসূত্রিতা এবং শাসন কালে বিভিন্নমুখী ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও নির্যাতন ছিল তৎকালীন মুসলিম লীগের দ্রুত স্বজনপ্রিয়তার সাধারণ কারণ। ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণ মুসলিম লীগের বিকাশকে রুদ্ধ করেছিল এবং এর ফলে সংগঠনের পক্ষে একদিকে যেমন সরকার পরিচালনার সুযােগ হয়নি, অন্যদিকে মুসলিম লীগকে ক্রমাগত জনমর্থন হারাতে হয়েছে। দলত্যাগ করেন অসংখ্য জনপ্রিয় নেতা ও কর্মী। এসব দলত্যাগী বিভিন্ন দল গঠন করেন, যেমন- আওয়ামী মুসলিম লীগ, কনভেনশন মুসলিম লীগ  ইত্যাদি। 

আরো পড়তে পারেনঃ- মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যেসহ তাৎপর্য আলোচনা কর।

উপসংহারঃ পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, পাকিস্তানের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ অবশেষে অবক্ষয়ের মুখে বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয় এবং নেতা-কর্মীরা মুসলিম লীগ ত্যাগ করতে থাকে তাছাড়া দলত্যাগীদের উদ্যোগে গঠিত সংগঠনগুলাের জনপ্রিয়তা মুসলিম লীগের পতন ত্বরান্বিত করে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলিম লীগ বিরােধী অনেক দল গড়ে ওঠে। এর মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলাে আওয়ামী মুসলিম লীগ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ১