OrdinaryITPostAd

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের উপর একটি প্রবন্ধ লিখ।

 

ভূমিকা : দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ধর্মীয় কারণে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান একটি ইসলামি রাষ্ট্র হলেও এর সমাজ ব্যবস্থার একক কোনাে আদর্শগত যােগসূত্র ছিল না। এর কারণ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার ভাষাগত বিরোধ। এ কারণে পূর্ব  পাকিস্তানের জনগণ পাকিস্তানের মৌলিক আদর্শের সাথে কোনােদিন একাত্ৰাতা অনুভব করতে পারে নি। আর এ কারণেই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলন এর  সূত্রপাত ঘটে। এর প্রভাব বাংলার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসের পরতে পরতে দেখতে পাওয়া যায় এবং এর সার্থক পরিণতি বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন ও স্বার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের উপর প্রবন্ধ 

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের উপর প্রবন্ধ লিখতে এর হলে এর সূদুরপ্রসারি ইতিহাস আলােচনা প্রয়ােজন। নিচে এ সম্পর্কে আলােচনা করা হলাে-

 


ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক পটভূমি 

বাংলার জাতীয় ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনার বীজ রােপিত হয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরেই যখন নিখিল পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক উপায়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার প্রয়াস চালানাে হয়। এরই প্রেক্ষিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার মাত্র ১৭ দিনের মাথায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ৩ সদস্য বিশিষ্ট ‘তমন্দুন মজলিস’ নামক একটি সংগঠন গঠিত হয়। এ সংগঠনের অপর সদস্যদ্বয় ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং শামসুল আলম। জন্মলগ্ন থেকেই সংগঠনটি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি উত্থাপন করে আসছিল। কিন্তু এ দাবি পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ কিছুতেই মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। প্রকৃতপক্ষে পূর্ব পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ভাষা সম্পর্কে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর একতরফা সিদ্ধান্ত এবং উক্ত সিদ্ধান্তকে জোরপূর্বক বাঙালিদের উপর চাপিয়ে দেয়ার ইচ্ছা এবং তৎপরতার মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে গ্রহণ করতে সচেষ্ট হন; যদিও বাস্তবে উর্দুভাষী লোকের অনুপাত ছিল অনেক কম।  নিচের ছকের মাধ্যমে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে–

 

       [[[ছককককককক]]

 

উৎস : বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়ন, লেক : ড. মাে: আব্দুল ওদুদ ভূঁইয়া, পৃষ্ঠা নং-১৭৩]

আরো পড়তে পারেনঃ- ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব বা তাৎপর্য ও পটভূমিকা আলােচনা কর।

ভাষা আন্দোলনের পর্যায় 

কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলায় তিন পর্যায়ের আন্দোলন পরিচালিত হয়।

নিচে এগুলাে আলােচনা করা হলো—

প্রথম পর্যায় 

১৯৪৭ সালের নভেম্বরে করাচিতে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে একটি শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত হয়। ফলে পূর্ব বাংলায় এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রচন্ড প্রতিবাদ শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে এ সিদ্ধান্তের বিরােধিতা করে ঢাকায় সর্বপ্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয় এবং কতিপয় দাবিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের নতি গৃহীত হয়। এ পরিষদের দাবি ছিল নিম্নরূপ-

ক. বাংলা ভাষা হবে পূর্ব বাংলার একমাত্র শিক্ষার বাহন এবং অফিসের-আদালতের প্রধান মাধ্যম।

খ.  পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে দুটি বাংলা ও উর্দু।



দ্বিতীয় পর্যায় 

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে কংগ্রেস দলীয় সদস্য, বিশেষত কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলা ভাষা ব্যবহারের দাবি জানান। কিন্তু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এই দাবির বিরােধিতা করেন। ফলে ঢাকায় ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী মহলে চরম অসন্তোষ দেখা দেয় এবং ২৬ ফেব্রুয়ারি সর্বত্র ধর্মঘট পালিত হয়। এভাবে সংগ্রাম পরিষদ” ১৫ মার্চ পর্যন্ত ধর্মঘট ও হরতাল পালনের মধ্য দিয়ে দেশব্যাপী আন্দোলন অব্যাহত রাখে অবশেষে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রি খাজা নাজিমুদ্দিন বাংলা ভাষার দাবির সমর্থনের আশ্বাস দিলে আন্দোলন প্রশমিত হয়। কিন্তু ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় এবং কার্জন হলের এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘােষণা দিলে আন্দোলন পুনরায় চাঙ্গা হয়ে ওঠে এবং দেশব্যাপী তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়।

তৃতীয় ও শেষ পর্যায় 

ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও চরম পর্যায় হলাে তৃতীয় পর্যায়। নিচে এ পর্যায় সম্পর্কে আলােচনা করা হলাে-

ক. লিয়াকত আলী খান ও নাজিমুদ্দিনের ঘােষণা : ১৯৫০ সালে লিয়াকত আলী খান এবং ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন পুনরায় একই ঘােষণা দেন যে, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” ফলে ছাত্র, বুদ্ধিজীবী মহলে চরম ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি হয় এবং আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। এ আন্দোলনের অংশ হিসেবেই ৩০ জানুয়ারি ঢাকার ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়।

খ. রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি : উর্দুকে রাষ্ট্রভাষ ঘােষণার প্রতিবাদে রাষ্ট্রভাষা বাংলা আন্দোলনকে আরাে তীব্রতর করার লক্ষ্যে ৩০ জানুয়ারি এক জনসভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করা হয়। এতে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে ভাষা দিবস এবং দেশব্যাপী হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

গ. ঐতিহাসিক মিছিল ও ১৪৪ ধারা ভঙ্গ : ২১ শে ব্রুেয়ারির উক্ত কর্মসূচিকে বানচাল করার জন্য তৎকালীন গভর্ণর নুরুল আমিন সরকার ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু সংগ্রাম পরিষদ এ নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মিছিল বের করলে পুলিশের সাথে ছাত্র-জনতার মারাত্নক সংঘর্ষ বাঁধে। এক পর্যায়ে পুলিশ মিছিলের উপর গুলি চাললে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেকে প্রাণ হারান এবং আহত হন অনেক ব্যক্তি এর ফল সারা বাংলায় আন্দোলন আগুলে ঘি ঢালার মত কাজ করে। ঢাকায় এ ঘটনার প্রতিবাদে তিন দিন লাগাতার হরতাল পালিত হয় এবং দেশব্যাপী প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে।

ঘ. রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ : অবশেষে তীব্র বিক্ষোভের মুখে সরকার নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং সাময়িকভাবে প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন বাংলাকে অন্যতম জাতীয় রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ সম্বলিত একটি প্রস্তাব প্রাদেশিক পরিষদে উত্থাপন করেন। প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। অত:পর ১৯৫৬ সালের সংবিধানের ২১৪ নং অনুচ্ছেদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দিলে বাঙালি জাতির বিজয় অর্জিত হয়।



ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব 

রেহমান সােবহান তার “বুজোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থার সংকট” নামক প্রবন্ধে বলেন, বস্তুত যে অন্তর্নিহিত দুর্বলতা পাকিস্তানের ভাঙন এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মূল কারণ, তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে। উল্লিখিত বক্তব্য থেকে স্পষ্ট প্রয়ীতমান হয় যে, স্বাধীন বাংলাৱেশ প্রতিষ্ঠার পিছনে মূল হাতিয়ার ছিল ভাষা আন্দোলন। এ আন্দোলন পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে এক ধাপ এগিয়ে দেয়। জনগণের মধ্যে এ আন্দোলনে এক নতুন জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটে এবং এ চেতনার মাধ্যমেই ক্রমে ক্রমে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশ লাভ করে। জনগণের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয় এ আন্দোলন। তাই বলা যায়, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের গণচেতনার প্রথম বহিঃপ্রকাশ এবং স্বাধিকার আন্দোলনের এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ।

উপসংহার : বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন পূর্ব বাংলার জনগনের মাঝে জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশের ক্ষেত্রে আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করে। ১৯৮০ সালের জিজ্ঞসা’র একুশে সংলনে ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য সম্পর্কে বলা হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন এক নতুন দিকদর্শন। এই আন্দোলন বাঙালির মনে যে বৈপ্লবিক চেতনা ও ঐক্যের উন্মেষ ঘটায় তা আমাদের পরবর্তী সকল আন্দোলনে প্রাণশক্তি ও অনুপ্রেরণা যােগায়। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্র-জনতা যে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা করে তা ক্রমশ শক্তিশালী হতে থাকে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয়, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের স্বাধিকার আন্দোলন, ১৯৬৮-৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচন এবং সর্বোপরি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষভাবে প্রেরণা যুগিয়েছে এ ভাষা আন্দোলন।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ১