OrdinaryITPostAd

গভীর সংঘর্ষের সন্ধানে -ইমপ্যাক্ট ফ্রম দ্য ডিপ

 



দার্শনিক ও ইতিহাসবিদ টমাস এস কুন-এর মতে বিজ্ঞান অনেকাংশেই একটি জীবের মত আচরণ করে। তার কথায়: ধীর অথচ নিরবচ্ছিন্নভাবে বিবর্তিত হওয়ার পরিবর্তে বিজ্ঞান মাঝে মাঝেই বিভিন্ন বিপ্লবী ঘটনার শিকার হয়। একটি নতুন প্রজাতির আবির্ভাবের মাধ্যমে যেমন জীবজগতে বিপ্লবের সৃষ্টি হয় তেমনি একটি নতুন তত্ত্বের আবির্ভাবে বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সৃষ্টি হয়, আর এরকম বিপ্লবের মাধ্যমে বিজ্ঞান সহসাই বড় ধরণের ঝাঁকুনি খায়। আমি যে বিষয়ে গবেষণা করি তার ক্ষেত্রে এ ধরণের বর্ণনার সত্যতা আরও বেশী। আমার গবেষণার বিষয় “গণ বিলুপ্তির কারণ ও ফলাফল”। পর্যায়ক্রমিকভাবে বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীবাসী জীবজগতের একটি বিশাল অংশের বিলুপ্তি ঘটেছে এবং বিলুপ্তির পর পুরো পৃথিবীর অবস্থাটাই গেছে পাল্টে। এ ধরণের বিলুপ্তিকে বলে গণ বিলুপ্তি

প্রায় দুই শতাব্দীকাল আগে বিজ্ঞানীরা এ ধরণের ঐতিহাসিক গণ বিলুপ্তির ঘটনা চিহ্নিত করেন। তখন মনে করা হয়েছিল, জলবায়ুর পরিবর্তন এবং শিকার, প্রতিযোগিতা ও রোগ-শোকের মত জৈব প্রভাবের কারণে ধীরে ধীরে স্বাভাবিকভাবেই এই গণ বিলুপ্তি ঘটেছে। কিন্তু ১৯৮০ সালে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলির বিজ্ঞানী ওয়াল্টার আলভারেজের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি বিজ্ঞানী দলের গবেষণার ফলাফল গণ বিলুপ্তি বিষয়ে কুনীয় বিপ্লবকে নতুন করে চাঙ্গা করে তোলে। তাদের গবেষণালব্ধ ফলাফলটি হল, আজ থেকে ৬৫ মিলিয়ন বছর পূর্বে ডাইনোসরদের বিলুপ্তি হঠাৎ করে হয়েছিল আর বহির্বিশ্ব থেকে আগত গ্রহাণুর আঘাতে সৃষ্ট বাস্তুতান্ত্রিক বিপর্যয়ই ছিল এই বিলুপ্তির কারণ। এরপরের দুই দশক ধরে এই চিন্তা ব্যাপক প্রসার লাভ করে যে, মহাকাশ থেকে আগত কোন বস্তুর আঘাতে পৃথিবীর জীববৈচিত্রের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। অনেক গবেষকরা মেনেই নেন, পাঁচটি বড়সড়ো গণ বিলুপ্তির মধ্যে আরও তিনটির কারণ বহির্জাগতিক বস্তুর এ ধরণের সংঘর্ষ। এই ধারণাটি সাধারণ্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করে হলিউড থেকে “ডিপ ইমপ্যাক্ট” ও “আর্মাগেডন” এর মত ব্লকবাস্টার চলচ্চিত্র মুক্তি পাওয়ার পর।

প্রাচীন জীবকূলের এভাবে বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণ ও ফলাফল নিয়ে আমাদের চিন্তা এখন আবার নতুন দিকে মোড় নিচ্ছে। স্তরীভূত শিলার বিভিন্ন স্তর থেকে নতুন নতুন সব ভূ-রাসায়নিক প্রমাণ বেরিয়ে আসছে। শিলাগুলোকে সেই বিলুপ্তি ঘটনার ভূতাত্ত্বিক চিত্রালেখ্য হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারটি হল “রাসায়নিক অবশিষ্টাংশ” যাকে এক ধরণের জৈব নির্দেশক বলা হয়। খুব ক্ষুদ্র জৈব-বস্তু যারা জীবাশ্ম ছেড়ে যেতে পারে না তারাই এই নির্দেশক তৈরী করে। এই সবগুলো উপাত্ত এক করে বোঝা গেছে, এ ধরণের আকস্মিক সংঘর্ষ গণ বিলুপ্তির একটি ব্যতিক্রমী কারণ মাত্র, কোন নিয়ম নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, পৃথিবী নিজেই জীবকূলের একটি বিরাট অংশের শত্রু হয়ে দাড়ায় যা আগে ভাবাও যেতো না। তবে এখন ভাবা যাচ্ছে, আমরা মানুষরা পৃথিবীর বুকে যে তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছি তাতে জীব মণ্ডলে আবার সে ধরণের বিপর্যয়ের সৃষ্টি হতে পারে।

আলভারেজের পর

এ ধরণের সংঘর্ষ নমুনার পক্ষে যে প্রমাণগুলো পাওয়া গেছে, নমুনাগুলো দিয়েই আবার সেই প্রমাণগুলো পরীক্ষা করা যাচ্ছে। আলভারেজ তার বাবা পদার্থবিজ্ঞান লুই ডব্লিউ আলভারেজ এবং নিউক্লীয় রসায়নবিদ হেলেন ভি মিচেলের সাথে মিলে যে উন্নততর নীতি আবিস্কার করেন তার দুইটি পৃথক প্রকল্প ছিল: প্রথমত, প্রায় ১০ কিলোমিটার ব্যাসের একটি বৃহৎ গ্রহাণু ৬৫ মিলিয়ন বছর পূর্বে পৃথিবীতে আঘাত হেনেছিল; দ্বিতীয়ত এই সংঘর্ষের পরিবেশগত প্রতিক্রিয়ায় সমগ্র জীববৈচিত্রের অর্ধেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এই সংঘর্ষের একটি প্রমাণ তারা পেয়েছেন। পার্থিব বস্তুতে ইরিডিয়ামের পরিমাণ খুব কম থাকে কিন্তু বহির্জাগতিক বস্তুতে তার আধিক্য দেখা যায়। গ্রহাণুর সংঘর্ষের ফলে পৃথিবীতে ইরিডিয়ামের যে ধূলিময় আভার সৃষ্টি হয়েছিল তার নিদর্শন আবিষ্কার করা গেছে।

এই বিস্ময় জাগানিয়া ঘোষণার পরপরই সেই বহির্জাগতিক ঘাতকের পদচিহ্ন আবিষ্কৃত হয়। মেক্সিকোর ইউকাটান উপদ্বীপের মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা সেই চিহ্নের নাম চিকশুলুব খাদ। এই আবিষ্কারের পর, বহির্জাগতিক বস্তুর আঘাতে ডাইনোসরদের রাজত্ব ধ্বংস হয়েছে এ নিয়ে যতটুকু সন্দেহ অবশিষ্ট ছিল তাও নিঃশেষ হয়ে যায়। সেই সাথে অন্য গণ বিলুপ্তি ঘটনাগুলোর কারণ নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়, একটি বিলুপ্তি সংঘর্ষের কারণে হলে অন্যগুলোই বা সে কারণে হতে পারবে না কেন? গত ৫০০ মিলিয়ন বছরে পাঁচবার পৃথিবীর জীবকূলের উল্লেখযোগ্য অংশ বিলুপ্তির শিকার হয়েছে। ৪৪৩ মিলিয়ন বছর পূর্বে অর্ডোভিসিয়ান যুগে এ ধরণের প্রথম বিলুপ্তির ঘটনা ঘটে। ৩৭৪ মিলিয়ন বছর পূর্বে দ্বিতীয় বিলুপ্তির ঘটনাটি ঘটে ডেভোনিয়ান যুগের শেষ দিকে। সবচেয়ে বড় গণ বিলুপ্তিটি ঘটেছিল ২৫১ মিলিয়ন বছর আগে পার্মিয়ান যুগের শেষ দিকে। সে সময় জলভাগের শতকরা ৯০ ভাগ এবং স্থলভাগের শতকরা ৭০ ভাগ জীব নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল, উদ্ভিদ, প্রাণী বা পোকামাকড় কেউই সে কড়াল থাবা থেকে রেহাই পায়নি। এরপর আবার বিশ্বব্যাপী মৃত্যুযজ্ঞ ঘটে ২০১ মিলিয়ন বছর পূর্বে, যে বিলুপ্তির মাধ্যমে ট্রায়াসিক যুগ শেষ হয়। আর সব শেষে ৬৫ মিলিয়ন বছর পূর্বে ক্র্যাটাসিয়াস যুগে ডাইনোসরদের বিলুপ্তি ঘটে।

১৯৯০-এর দশকে জীবাশ্ববিদ ডেভিড রাউপ তার এক্সটিংশন্‌স: ব্যাড জিন্‌স অর ব্যাড লাক? নামক বইয়ে উল্লেখ করেন, সবগুলো গণ বিলুপ্তিই বহির্জাগতিক বস্তুর সংঘর্ষের কারণে হয়েছিল এবং ছোটখাট আরও সংঘর্ষের কারণে সীমিত পর্যায়ে আরও বিলুপ্তির ঘটনা ঘটেছে। ক্র্যাটাসিয়াস ও টার্শিয়ারি যুগের মধ্যে যে ভূতাত্ত্বিক সীমানা রয়েছে তাও এ ধরণের সংঘর্ষ ঘটনার সাক্ষ্য বহন করে। নির্দিষ্ট প্রমাণের মধ্যে রয়েছে: চিকশুলুব খাদ, ইরিডিয়ামের স্তর, সংঘর্ষের ধ্বংসাবশেষ যার মধ্যে আছে পৃথিবীব্যাপী বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে থাকা চাপ-সংকুচিত পাথর। এছাড়া প্রাচীন পলিতে পাওয়া রাসায়নিক তথ্যাদি আমাদের জানিয়ে দেয়, গণ বিলুপ্তিগুলোর পর পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ও জলবায়ু কিভাবে দ্রুত পরিবর্তিত হয়েছিল।

আরও কিছু বিলুপ্তি যুগের নিদর্শনে সেই বহির্জাগতিক বস্তুর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ভূতাত্ত্বিকেরা ১৯৭০-এর দশকে ডেভোনিয়ান যুগের শেষ দিককার বিলুপ্তি ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট একটি ইরিডিয়াম স্তরের সন্ধানও পেয়েছেন। আর ২০০২ সালের মধ্যে বেশ কিছু আবিষ্কার প্রস্তাব করছে যে, ট্রায়াসিক যুগের শেষ পর্যায় ও পার্মিয়ান যুগের শেষ পর্যায়ের সীমানার মধ্যবর্তী কোন এক সময়ে বহির্জাগতিক বস্তুর সংঘর্ষ ঘটেছিল। এছাড়া ট্রায়াসিক স্তরে সামান্য পরিমাণ ইরিডিয়ামের সন্ধান মিলেছে। একটি উল্লেখযোগ্য প্রমাণ হচ্ছে, পার্মিয়ান যুগের স্বতন্ত্র “বাকিবল” (Buckyball) কার্বন অণু যার মধ্যে বহির্জাগতিক গ্যাস আটকা পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এসব কারণে অনেক বিজ্ঞানীই সন্দেহ করছেন, পাঁচটি বড় ধরণের গণ বিলুপ্তির চারটিই ঘটেছে বহির্জাগতিক বস্তুর সংঘর্ষের কারণে। একমাত্র ব্যতিক্রম হল অর্ডোভিসিয়ান যুগের ঘটনাটি। আমাদের মহাজাগতিক প্রতিবেশের কোন এক তারার বিস্ফোরণের কারণে সৃষ্ট বিকিরণের কারণে সে বিলুপ্তিটি ঘটেছিল বলে মনে করা হয়।

অধুনা গবেষকরা এসব উপাত্ত একসাথে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন এবং এই প্রচেষ্টার কারণে এমনকিছু একটা বেরিয়ে আসছে যাকে এ ধরণের সংঘর্ষ ঘটনার সাথে ঠিক মেলানো যায় না। নতুন জীবাশ্ম বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পার্মিয়ান ও ট্রায়াসিক যুগের বিলুপ্তিটি কয়েক হাজার বছরের ব্যবধানে ধীরে ধীরে ঘটেছে। তার উপর আবিষ্কৃত হয়েছে, বায়ুমণ্ডলে কার্বনের পরিমাণ পর্যায়ক্রমিকভাবে বাড়ে আর কমে, যাকে কার্বন চক্র নামে অভিহিত করা হয়। এ ধরণের আবিষ্কার অব্যাহত থাকলে অচিরেই হয়তো আমাদের মেনে নিতে হবে, কোন আকস্মিক সংঘর্ষ নয় বরং ক্রমান্বয়িক পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণেই গণ বিলুপ্তিগুলো ঘটেছিল।

আকস্মিক সংঘর্ষই একমাত্র সমাধান নয়

ক্রিটাশিয়াস-টার্শিয়ারি গণ বিলুপ্তি ঘটনাকে সংক্ষেপে কে/টি ঘটনা বলা হয়। কে/টি ঘটনায় বৃহদাকার বস্তুর যে সংঘর্ষের উল্লেখ করা হয়েছে তার সাথে একটি বড়সড়ো ভূমিকম্পের মাধ্যমে বড় একটি শহরের সমতল ভূমিতে পরিণত হওয়ার তুলনা করা যেতে পারে। হয়তো বিপর্যয়টি খুব আকস্মিক, বিধ্বংসী এবং স্বল্পায়ু, আর শেষ হয়ে যাওয়ার পরপরই নতুন করে শহর নির্মাণ শুরু হয় (হিরোশিমা ও নাগাসাকির সাথে তুলনা করতে পারেন)। কে/টি বিলুপ্তির কার্বন-সমাণু উপাত্ত এবং জীবাশ্ম রেকর্ড পরীক্ষা করে ধ্বংস ও পুনর্গঠনের এই চক্রের আলামত পাওয়া গেছে। অবশ্য জীবাশ্ম রেকর্ড পর্যালোচনা করতে বিজ্ঞানীদের খানিকটা বেশী কষ্ট হয়েছে। খুব ছোট ও সাংখ্যাগুরু জীবাশ্মগুলো জানান দেয় যে, কে/টি সীমানায় আকস্মিকভাবে তাদের মৃত্য ঘটেছিল। এ ধরণের জীবাশ্মের মধ্যে রয়েছে ক্যালকারিয়াস ও সিলিয়াস প্ল্যাংকটন এবং বিভিন্ন উদ্ভিদের স্পোর। কিন্তু সমসাময়িক জীবাশ্ম শ্রেণীর অপেক্ষাকৃত বড়গুলো উল্টো কথা বলছে। জীবাশ্ম যতই বড় তাদের বিলুপ্তি ততই ক্রমান্বয়িক ও ধীর।

একসময় জীবাশ্মবিদরা বুঝতে পারেন, পরীক্ষিত অধিকাংশ মৃত্তিকা ও শিলার স্তরে বড় আকারের জীবাশ্ম নমুনার পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম। আর এ কারণেই বিলয়-পুনর্নিমাণের এই আপাত গড়নের সৃষ্টি হয়েছে। এই নমুনায়ন সংকটকে মোকাবেলা করে বিলুপ্তি পথের সন্ধান পেতে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির জীবাশ্মবিদ চার্লস মার্শাল একটি নতুন পরিসাংখ্যিক প্রোটোকল তৈরী করেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল জীবাশ্মের ব্যপ্তিকে পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে নতুনভাবে পরীক্ষা করে। এর মাধ্যমে তিনি একটি প্রদত্ত সময়সীমার মধ্যে একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির বিলুপ্তির সম্ভাব্যতা নির্ণয় করেন। এই প্রক্রিয়ায় সাফল্য আসে। বিরল জীবাশ্মগুলো হাতড়েও যে তথ্য পাওয়া যায়নি নতুন এই প্রোটোকল সেই তথ্যকেই বের করে আনে।

১৯৯৬ সালে আমি মার্শালের সাথে কাজ করা শুরু করি। উদ্দেশ্য ছিল কে/টি সীমানার স্ট্র্যাটিগ্রাফিক (একটি সাধারণ সময় স্কেলে কোন যুগের মৃত্তিকা নমুনা পরীক্ষা করার নাম) অংশের উপর মার্শালের প্রোটোকল প্রয়োগ করা। এর মাধ্যমে আমরা দেখাতে সক্ষম হই, ইউরোপের অ্যামোনাইট শ্রেণীর জলজ প্রাণী ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়েছে বলে যে ধারণাটি করা হচ্ছিল তা সঠিক নয়, বরং কে/টি সীমানায় আকস্মিক বিলুপ্তির সাথেই পরীক্ষণের ফলাফল বেশী সঙ্গতিপূর্ণ। উল্লেখ্য, অ্যামোনাইটরা হল বৃহদাকার জলজ প্রাণীদের মধ্য সবচেয়ে বিরল যার মধ্যে রয়েছে চেম্বার্ড নটিলাসের মত মলাস্কা পর্বের অন্যান্য প্রাণী। কিন্তু, এরপর আমি ও অন্যান্য গবেষকরা মিলে পূর্ববর্তী বিলুপ্তি ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে এই নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করি। এর ফলে সে সময়ে আকস্মিক বিলুপ্তির সম্ভাবনা নাকচ হয়ে যায়। আমার গ্রুপ মৃত্তিকা স্তরে পার্মিয়ান ও ট্রায়াসিক যুগের শেষ দিকে বিলুপ্ত জলজ ও স্থলজ সব প্রাণীর জীবাশ্ম নিয়ে পরীক্ষা চালায়। এতে দেখা যায়, বিলুপ্তি ঘটেছে ধীরে ধীরে ক্রমান্বয়িকভাবে। অবশ্য বিলুপ্তির সময় সেই সীমানার আশেপাশেই রয়েছে।

বিলুপ্তির হার পরীক্ষার আরেকটি শক্তিশালী পদ্ধতি কার্বন সমাণুর রেকর্ড পর্যবেক্ষণ করা। সেই পর্যবেক্ষণেও ধীর-বিলয়ের নিদর্শন মিলেছে। কার্বনের তিনটি সমাণু আছে যাদের মধ্যে একমাত্র পার্থক্য নিউক্লিয়াসে নিষ্ক্রিয় নিউট্রনের পরিমাণ। এই তিনটির মধ্যে কার্বন-১৪ নামক সমাণুটির সাথে কমবেশী সবাই পরিচিত। কারণ, এই সমাণু দিয়ে জীবাশ্ম কঙ্কাল বা প্রাচীন পাললিক শিলার বয়স নির্ণয় করা হয়। কিন্তু গণ বিলুপ্তি ব্যাখ্যা করার জন্য আমরা এর চেয়েও ভাল একটি পদ্ধতি পেয়েছি, আর তা হল কোন ভূতাত্ত্বিক রেকর্ডে উপস্থিত কার্বন-১৩ এবং কার্বন-১২ সমাণু দুটির পরিমাণের অনুপাত। এই অনুপাতের মাধ্যমে বয়স তো নির্ণয় করা যায়ই, সেই সাথে ঐ সময় নির্দিষ্ট উদ্ভিদ প্রজাতির বিস্তৃতি কতটা ছিল তাও বের করা যায়।

এর কারণ, সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া পরিবেশে কার্বন-১২ ও কার্বন-১৩ ‘র অনুপাত পরিবর্তনে বিশাল ভূমিকা রাখে। উদ্ভিদেরা পরিবেশ থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে তা থেকে জৈব কার্বন ও শক্তি উৎপাদন করে। এর মাধ্যমেই বেঁচে থাকে তারা। সৌভাগ্য আমাদের, প্রাণীদের এতো কষ্ট করতে হয়না, উদ্ভিদের আবর্জনা খেয়েই বেঁচে থাকতে পারি আমরা। কিন্তু, আসল ব্যাপার হল, প্রাণীরা কার্বন ডাউ অক্সাইড শোষণ করতে গিয়ে পক্ষপাতিত্ব করে। তারা সেই কার্ডন ডাই অক্সাইডই শোষণ করে যার মধ্যে কার্বন-১২ আছে, অন্যগুলো সহজে নিতে চায়না- তা সে সমুদ্রে ভাসমান খুদেকায় প্ল্যাংকটনই হোক আর বিশাল বৃক্ষই হোক। সুতরাং, যখন পৃথিবীতে প্রচুর পরিমাণে উদ্ভিদ থাকে তখন পরিবেশে কার্বন-১৩ ‘র পরিমাণ থাকে বেশী। আর উদ্ভিদের কারণেই কার্বন-১২ ‘র পরিমাণ একেবারে কমে যায়। তাই কার্বন ১৩-১২ ‘র অনুপাতও যায় বেড়ে।

গণ বিলুপ্তির আগে, সে সময় এবং বিলুপ্তির পরে এই দুটি সমাণুর পরিমাণ নির্ণয় করে তা থেকে অনুপাত বের করা হয়। আর এভাবেই গবেষকরা জলে ও ভূমিতে সে সময় কি পরিমাণ উদ্ভিদ ছিল তা বের করে ফেলতে পারেন। উপাত্ত সংগ্রহের পর গবেষকরা অনুভূমিক অক্ষে সময় আর উল্লম্ব অক্ষে কার্বন-১৩ ‘র পরিমাণ বসিয়ে লেখ অংকন করেন। কে/টি সীমানার যে লেখচিত্রটি আমরা পেয়েছিলাম তাতে দেখা যায়, কার্বন-১৩ ‘র পরিমাণ হঠাৎ করে একেবারে কমে গেছে এবং পরে আবার বেড়েছে। এ থেকে প্রমাণিত হয়, সে সময় সংঘর্ষের কারণে উদ্ভিদ প্রজাতির বিশাল অংশ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল এবং পরে আবার ফিরে এসেছে। স্থলভাগের বড় বড় গাছ এবং জলভাগের ছোট ছোট প্ল্যাংকটন সবার জন্যই এটি সতত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।

২০০৫ সালে আমরা পার্মিয়ান যুগের জন্য উপর্যুক্ত লেখটি আঁকি এবং অতি সম্প্রতি ট্রায়াসিক যুগের জন্যও সেটি আঁকা সম্ভব হয়েছে। এই দুটি লেখ কিন্তু আগেরটির থেকে একেবারে ভিন্ন কথা বলে। এগুলোতে দেখা যায়, সমাণুটির পরিমাণ ৫০,০০০ থেকে ১০০,০০০ বছরের ব্যবধানে কখনও কমেছে এবং কখনও বেড়েছে। অর্থাৎ সে সময় জীবজগতের একটি অংশ কখনও বিলুপ্ত হয়েছে এবং কখনও আবার সৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্টির উদ্দেশ্যই যেন ছিল ধ্বংস হওয়া। এ ধরণের ধ্বংস-বিলয় গড়ন সৃষ্টির একটি কারণ হতে পারে, বারবার গ্রহাণু জাতীয় বহির্জাগতিক বস্তুর আঘাত। কিন্তু, খনিজ রেকর্ড পর্যবেক্ষণ করে সে সময় কোন গ্রহাণু আঘাত করেছে বলে জানা যায় না।

অনেকে মিলে এই গুরুত্বপূর্ণ বিলুপ্তি ঘটনাগুলো নিয়ে গবেষণা করছেন। অন্য কোন গবেষক দল এখন পর্যন্ত পার্মিয়ান সীমানার সময়ের কোন কার্বন বাকিবল (buckyball) অণুর সন্ধান পায়নি যাতে বহির্জাগতিক গ্যাস আটকা পড়ে আছে। সে সময়ের একটি আঘাতপ্রাপ্ত কোয়ার্জের সন্ধান পাওয়া গেছে। কিন্তু, অস্ট্রেলিয়ার নিকটবর্তী সমুদ্রতলে ও অ্যান্টার্কটিকার বরফের নিচে প্রাপ্ত এই কোয়ার্জ খাদগুলো আসলেই সংঘর্ষ ক্র্যাটার নাকি নিছক প্রাকৃতিক খাদ তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ট্রায়াসিক যুগের শেষদিকের ইরিডিয়াম স্তরের যে সন্ধান পাওয়া গেছে তার পরিমাণ এতো কম যে মনে করা হচ্ছে, ছোট ছোট কয়েকটি গ্রহাণুর আঘাতে তেমনটি হয়েছিল। কিন্তু, সেগুলো মোটেই গণ বিলুপ্তির জন্য যথেষ্ট নয়। কে/টি সীমানার বিলুপ্তির মত বহির্জাগতিক বস্তুর সংঘর্ষ যদি পূর্বতন সেই বিলুপ্তিগুলো না ঘটিয়ে থাকে, তবে এর প্রকৃত কারণ কি? নতুন ধরণের এক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, পৃথিবী নিজেই শত্রুতা করে তার অধিবাসীদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে এবং হয়তো তা-ই সে করেছিল।

ভয়ংকর গ্রিনহাউজ

প্রায় অর্ধযুগ আগে ভূতাত্ত্বিকদের কয়েকটি দল জৈব রসায়নবিদদের সাথে মিলে পৃথিবীর ইতিহাসের সংকটময় মূহুর্তগুলোতে এর পরিবেশের অবস্থা অধ্যয়ন শুরু করেছিল। তাদের মূল কাজ ছিল প্রাচীন শিলাস্তর থেকে জৈব অবশেষ নিষ্কাশন করা। নিষ্কাশিত অবশেষে জৈব নির্দেশক নামে পরিচিত রাসায়নিক জীবাশ্ম সন্ধান করা হতো। কিছু জীব বেশ শক্তিশালী জৈব অণু অবশেষ হিসেবে রেখে যায় যে অণুগুলো নিজেদের ক্ষয় থেকে রক্ষা পেয়ে বিভিন্ন পাললিক শিলার অভ্যন্তরে বেঁচে থাকে। অনেক আগে বিলুপ্ত যে জীবগুলো কোন দৃঢ় কঙ্কালরূপী অবশেষ রেখে যায় না তাদের জীবনধারণের প্রমাণ হিসেবে এই জৈব নির্দেশকগুলো বেশ কার্যকর। যেমন, বিভিন্ন প্রকার অণুজীব এমন কিছু অবশেষ প্রমাণ হিসেবে রেখে গেছে যা থেকে বোঝা যায় তাদের কোষ ঝিল্লীতে লিপিড ছিল। অবশেষ হিসেবে রক্ষিত অণুগুলো থেকে এসব তথ্য বের করে আনা সম্ভব হয়েছে নতুন ধরণের এক ভর বর্ণালিবীক্ষণ পদ্ধতি ব্যবহার করে। এই পদ্ধতিতে ভর অনুযায়ী অণুগুলোকে পৃথক করা হয়।

প্রথম দিকে যে জৈব নির্দেশকগুলো নিয়ে গবেষণা করা হয়েছিল সেগুলো এমন সব শিলা থেকে নিষ্কাশিত যাদের বয়স পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভবের সময়ের চেয়েও বেশী। এ কাজ করা হয়েছিল ঠিক কিভাবে পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব হয়েছে তা উদ্‌ঘাটন করার জন্য। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে বিজ্ঞানীরা গণ বিলুপ্তি সীমানার সময়কার শিলাস্তরের জৈব নির্দেশকগুলো নিয়ে গবেষণা করছেন। এই পরীক্ষা করতে গিয়ে বিস্ময়কর এক তথ্য বেরিয়ে এসেছে। কে/টি সীমানা ছাড়া অন্য সকল সময়ের ক্ষেত্রেই এই তথ্যের সত্যতা মিলেছে। তথ্যটি হল, পৃথিবীর মহাসাগরগুলোতে সঞ্চিত অক্সিজেনের পরিমাণ একাধিকবার একেবারে কমে গিয়েছিল। আর বিভিন্ন সময়ে উদ্ভিদ ও প্রাণী বিলুপ্তির ঠিক আগে আগেই এই কমে যাওয়ার ঘটনাগুলো ঘটেছিল। এই ঘটনাগুলো “অ্যানোক্সিয়া” নামে পরিচিত।

শিলাস্তর থেকে প্রাপ্ত জৈব নির্দেশকের মধ্যে বিপুল পরিমাণে সালোকসংশ্লেষী সবুজ সালফার ব্যাক্টেরিয়ার অবশেষ পাওয়া গেছে। এ ধরণের আরেকটি অণুজীব হচ্ছে সালোকসংশ্লেষী রক্তবর্ণ সালফার ব্যাক্টেরিয়া। এই অণুজীবগুলো নিশ্চল হ্রদের তলদেশ বা মৃত সাগরের মত স্বল্প অক্সিজেন বিশিষ্ট পরিবেশে বসবাস করে এবং এরা বেশ অনিষ্টকর জীব। নিজেদের প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপাদনের জন্য তারা হাইড্রোজেন সালফাইডকে জারিত করে সালফার তৈরী করে, অথচ এই হাইড্রোজেন সালফাইড অন্য যেকোন জীবের জন্য এক প্রকার বিষ। দেখা যাচ্ছে এই অণুজীবগুলো অক্সিজেন ছাড়াই বেঁচে থাকতে পারে। গণ বিলুপ্তি সীমানায় তাদের সংখ্যাধিক্যের কারণ এ থেকেই বোঝা যায়। এবং এই সংখ্যাধিক্যের মাধ্যমে গণ বিলুপ্তির কারণ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্তও উন্মোচিত হয়।

বিজ্ঞানীরা অনেক দিন থেকেই জানতেন, স্বাভাবিকের তুলনায় গণ বিলুপ্তি সীমানার সময়ে পরিবেশে অক্সিজেনের পরিমাণ কম ছিল। কিন্তু এর সুস্পষ্ট কোন কারণ তারা বের করতে পারেন নি। সংঘর্ষের বিপরীতে এক্ষেত্রে যে তত্ত্বটি প্রচলিত ছিল তা হল: গণ বিলুপ্তির সময়ে যে বিপুল পরিমাণ অগ্ন্যুৎপাতের প্রমাণ পাওয়া গেছে তার কারণে পরিবেশে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ অনেক বেড়ে গিয়েছিল। এই বর্ধনের কারণে সৃষ্ট গ্রিনহাউজ প্রতিক্রিয়ায় অক্সিজেন স্বল্পতার সৃষ্টি হয়। কিন্তু পার্মিয়ান যুগের শেষ দিকের গণ বিলুপ্তির সময়ে জলজ জীবকূলের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পেছনে এই অগ্ন্যুৎপাতকে দায়ী করা যায় নি, কারণ এর জন্য শুধু অগ্ন্যুৎপাত যথেষ্ট নয়। উপরন্তু, উদ্ভিদকূলের বিলুপ্তি কার্বন ডাই অক্সাইড বেড়ে যাওয়ার কারণে হতে পারে না, কারণ তারা তো এই গ্যাসের উপরই নির্ভরশীল। আর উত্তাপের ব্যাপারে বলতে হয়, সে সময়কার উদ্ভিদগুলোর পক্ষে সে উত্তাপ সইয়ে নেয়া অস্বাভাবিক নয়।

কিন্তু, ট্রায়াসিক ও পার্মিয়ান যুগের শেষ দিককার মহাসাগরীয় পাললিক শিলা থেকে প্রাপ্ত জৈব নির্দেশক পরীক্ষার মাধ্যমে রাসায়নিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, সে সময় মহাসাগর জুড়ে হাইড্রোজেন সালফাইড গ্রহণকারী ব্যাক্টেরিয়ার পরিমাণ প্রচুর বেড়ে গিয়েছিল। এখানে মনে রাখা দরকার, এই অণুজীবগুলো অক্সিজেন-মুক্ত পরিবেশেই কেবল বেঁচে থাকতে পারে এবং সেই সাথে তাদের প্রয়োজন পড়ে সূর্যালোকের। এই পরিপ্রেক্ষিতে অগভীর জলভূমির নিম্নস্থিত মৃত্তিকা স্তরে এই জৈব নির্দেশকগুলো পাওয়ার অর্থ হচ্ছে, পার্মিয়ান যুগের শেষ দিকে সাগরের অভ্যন্তরের জলভাগই কেবল নয়, সমুদ্রতলেও তখন অক্সিজেন ছিল না। তার বদলে ছিল প্রচুর পরিমাণে হাইড্রোজেন সালফাইড।

বর্তমান যুগে সমুদ্রের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত পুরো অংশেই অক্সিজেনের ঘনত্ব সমান। কারণ বায়ুমণ্ডল থেকে অক্সিজেন সমুদ্রের পানিতে দ্রবীভূত হয় এবং পরিচলনের মাধ্যমে গভীরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য ব্যতিক্রমও রয়েছে। যেমন, মৃত সাগরের জলে কোন অক্সিজেন নেই। এ ধরণের অক্সিজেনবিহীন পরিবেশে তাই এখনও কিছু অক্সিজেন বিদ্বেষী জীব বসবাস করতে পারে। এ পরিবেশের অবায়বীয় জীবগুলো যে বিপুল পরিমাণ হাইড্রোজেন সালফাইড তৈরী করে তাও সমুদ্রের পানিতে দ্রবীভূত হয়ে যায়। এই জীবগুলো সাধারণত গভীর সমুদ্রে বসবাস করে। সেখান থেকে তৈরী হওয়া হাইড্রোজেন সালফাইডের পরিমাণ যখন অনেক বেড়ে যায় তখন তা উপরের দিকে ব্যাপীত হতে শুরু করে এবং নিচের দিকে ব্যাপীত হতে থাকা অক্সিজেনের মুখোমুখী হয়। যতক্ষণ এ দুয়ের মধ্যে সাম্যাবস্থা বজায় থাকে ততক্ষণ হাইড্রোজেন সালফাইড (গভীর জলে) এবং অক্সিজেন পূর্ণ (পৃষ্ঠতলীয় জলে) জলভাগ একে অপর থেকে পৃথক অবস্থায় থাকে। আর এ দুয়ের ছেদকতলে একটি নতুন অবস্থার সৃষ্টি হয় যার নাম কেমোক্লাইন। সাধারণত সকল সবুজ ও রক্তবর্ণ সালফার ব্যাক্টেরিয়া এই কেমোক্লাইনে বাস করে। এর ফলে তারা একইসাথে হাইড্রোজেন সালফাইড এবং সূর্যের আলো পায়।

অধুনা পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির ভূবিজ্ঞানী লি আর কাম্প এবং মাইকেল এ আর্থার হিসাব করে দেখেছেন, কোন কারণে সমুদ্রজলে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেলে গভীর জলের অবায়বীয় এই অণুজীবগুলো বিশেষ সুবিধা পায়। এর ফলে তারা আরও অধিক পরিমাণে হাইড্রোজেন সালফাইড তৈরী করে। এভাবে হাইড্রোজেন সালফাইড বাড়তে বাড়তে একসময় অক্সিজেনপূর্ণ জলভাগের সাথে বিরাজমান সাম্যাবস্থা ভেঙে যায় এবং তাদের মধ্যবর্তী কেমোক্লাইনের আর কোন অস্তিত্ব থাকে না। তখনই গভীরস্থিত হাইড্রোজেন সালফাইডপূর্ণ জল একেবারে পৃষ্ঠতলে উঠে আসে। এর ফলে ভয়ংকর এক অবস্থার সৃষ্টি হয়। সমুদ্রতল থেকে বিষাক্ত হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস উৎক্ষিপ্ত হতে থাকে।

এই বিজ্ঞানীদ্বয় তাদের গবেষণা থেকে অনুমান করেছেন, পার্মিয়ান যুগের শেষ দিকে এমনই একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। অর্থাৎ বিশাল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উৎক্ষিপ্ত বিষাক্ত গ্যাসের কারণে স্থলভাগের প্রায় সকল উদ্ভিদ ও প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য এই বিনাশী গ্যাসকেই একমাত্র ঘাতক বলা ঠিক হবে না। ইউনিভার্সিটি অফ অ্যারিজোনার বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার পাভলভকৃত নকশা অনুসারে, বিষাক্ত হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস একাধারে গ্রহের ওজোন স্তরকেও নষ্ট করে দিয়েছিল, যে ওজোন স্তর গ্রহস্থিত জীবকূলকে সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি থেকে বাঁচায়। গ্রিনল্যান্ডে প্রাপ্ত জীবাশ্ম বীজাণু থেকে জানা গেছে, পার্মিয়ান যুগের শেষ দিকে ওজোন স্তরের এমন ক্ষতি আসলেই হয়েছিল। এই বীজাণুগুলোতে এমন সব বিকৃতির নিদর্শন পাওয়া গেছে যা অতিবেগুনি রশ্মির অত্যধিক প্রভাবের কারণেই কেবল হতে পারে। বর্তমানে আমরা আরও দেখতে পাই, ওজোন স্তরের যেখানে ছিদ্র হয়েছে তার নিচে পৃথিবীর অংশটিতে জীবকূল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যেমন, অ্যান্টার্কটিকার উপরে এমন ছিদ্র থাকার কারণে, সেখানকার ফাইটোপ্ল্যাংকটনের বায়োমাস দ্রুত নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে। এবং এদের ধ্বংসের কারণে যদি খাদ্য শিকল ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে, তাহলে আর বেশিদিন নয়; অচিরেই হয়তো ভূভাগের অন্য সব জীব বিলুপ্তীর সম্মুখীন হবে।

লি আর কাম্প ও মাইকেল এ আর্থার পরিমাপ করে দেখেছেন, বর্তমানে পৃথিবীর সবগুলো আগ্নেয়গিরি থেকে মোট যে পরিমাণ বিষাক্ত গ্যাস উৎক্ষিপ্ত হয় তার তুলনায় বিলুপ্তি সীমানার যুগে সমুদ্রতল থেকে উৎক্ষিপ্ত হাইড্রোজেন সালফাইডের পরিমাণ ছিল প্রায় ২০০০ গুণ বেশি। এই বিশাল পরিমাণ বিষাক্ত গ্যাস তখনকার সব উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতিকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে হাইড্রোজেন সালফাইডের বিষাক্ততা বৃদ্ধি পায়। তাই ভৌগলিক উষ্ণায়নের স্বল্প সময়ের মধ্যে এই বিষাক্ততা অনেক বারই বেড়ে গিয়েছিল, যার কারণে এ সময়ে অনেকবার জীবকূল বিলুপ্তির শিকার হয়। আর এই ছোটখাট বিলুপ্তির সময়েই সম্ভবত সুপ্রাচীন অগ্ন্যুৎপাতগুলো শুরু হয়েছিল।

এরকম কয়েকটি গণ বিলুপ্তির সময়কার অগ্ন্যুৎপাতের কারণে ভূপৃষ্ঠ ও সমুদ্রতলের কয়েক হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা লাভায় ঢেকে গিয়েছিল। এসব লাভার একটি উল্লেখযোগ্য অপজাত ছিল বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড ও মিথেন গ্যাস যা লাভা স্তর থেকে বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করেছিল। এ কারণেই ভৌগলিক উষ্ণায়ন ত্বরান্বিত হয়। পার্মিয়ান ও ট্রায়াসিক যুগের শেষ ভাগ, জুরাসিক যুগের প্রথম ভাগ, ক্রিটাশিয়াস যুগের মধ্য ভাগ ও প্যালিওসিন যুগের শেষ ভাগে বায়ুমণ্ডলে বিরাজমান কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ নির্ণয় করা গেছে। অন্য কিছু যুগের মত এই যুগগুলোতেও বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়ে গিয়েছিল। এবং এই বেড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে গণ বিলুপ্তি শুরু হওয়ার ঠিক আগে। পুরো বিলুপ্তি শেষ হয়ে যাওয়ার পর আরও প্রায় হাজার, লক্ষ বছর কার্বন ডাই অক্সাইডের এই পরিমাণ অক্ষুন্ন ছিল।

এ সময় সবচেয়ে অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিল সমুদ্রগুলো। উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রতল বায়ুমণ্ডল থেকে অক্সিজেন শোষণ করতে পারছিল না। দেখা যাচ্ছে, একদিকে অগ্ন্যুৎপাতের কারণে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল আর কমে গিয়েছিল অক্সিজেনের পরিমাণ। যাও অক্সিজেন অবশিষ্ট ছিল তাও ভৌগলিক উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রজলে দ্রবীভুত হতে পারছিল না। অক্সিজেন স্বল্পতার বিপরীতে, গভীর সমুদ্রে সালফার ব্যাক্টেরিয়ার মত অণুজীবের মাধ্যমে সৃষ্ট হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস উপরের দিকে উঠতে শুরু করেছিল। ফলশ্রুতিতে এক সময় সেই অণুজীবগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠে এসেও বেঁচে থাকার ক্ষমতা অর্জন করে। অপরদিকে অক্সিজেনের উপর নির্ভরশীল জীবকূল ক্রমশ ধ্বংসের সম্মুখীন হচ্ছিল। পুরো সমুদ্রই অক্সিজেনশূন্য হয়ে উঠে। এভাবে হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস একসময় ভূভাগের সব জীব ধ্বংস করে ফেলে। এই প্রতিকূল পরিবেশে কোন জীবের পক্ষেই বেঁচে থাকা সম্ভব ছিল না।

কাম্পের প্রকল্প জল ও স্থলভাগের জীবকূলের বিলুপ্তির মধ্যে একটি সংযোগ স্থাপনে সমর্থ হয়। পর্মিয়ান যুগের শেষ ভাগে কার্বন ডাই অক্সাউড বেড়ে যাওয়ার কারণে কিভাবে উভয় অঞ্চলের জীবই ধ্বংসের মুখোমুখী হয় তাও ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয় এই প্রকল্পের মাধ্যমে। তাছাড়া পার্মিয়ান সীমানার সময়ে সালফার ব্যাক্টেরিয়ার মত অণুজীবের আধিক্যের কারণও এ থেকে বোঝা যায়। গণ বিলুপ্তির পর এই বিষাক্ত বায়ুমণ্ডল ও পরিবেশ ঠিক হতে অনেক সময় লাগার কথা, এবং আসলেই যথেষ্ট সময় লেগেছিল।

অবশেষে দেখা যায়, কেবল পার্মিয়ান যুগের শেষ ভাগের জন্যই এই প্রকল্প সত্য নয়, আরও বেশ কিছু ছোটখাট বিলুপ্তি ঘটনায় এর অবদান রয়েছে। যেমন, ৫৪ মিলিয়ন বছর আগে প্যালিওসিন যুগের শেষ দিকে স্বল্প পরিসরে যে গণ বিলুপ্তি ঘটনা ঘটেছিল তা এই প্রকল্পের মাধ্যমেই ব্যাখ্যা করা যায়। কারণ সেই বিলুপ্তির আগে স্বল্প পরিসরে ভৌগলিক উষ্ণায়নের সৃষ্টি হয় এবং তার কারণে সমুদ্রগুলো অক্সিজেনহীন হয়ে পড়ে। জৈব নির্দেশক অন্বেষা এবং ভূতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে দেখা যায়, ট্রায়াসিকের শেষ ভাগ, ক্রিটাশিয়াসের মধ্যভাগ এবং ডেভোনিয়ান যুগের শেষ ভাগেও এ ধরণের প্রতিকূল গ্রিনহাউজ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। এ থেকে এখন বোঝা যাচ্ছে, চূড়ান্ত বিরূপ পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার এ প্রক্রিয়া বারংবার ঘটতে পারে।

সবচেয়ে জটিল ও ভীতিকর প্রশ্নটি হচ্ছে: আমাদের প্রজাতি তথা মানুষের কি এ ধরণের বিরূপ পরিবেশকে এখন ভয় করা উচিত? একবার নয় বারবার যা ঘটেছে আবার কি তা ঘটতে পারে না? পরিবেশ থেকে কি পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড সে সময় বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করেছিল তার সঠিক পরিমাণ আমরা জানিনা, তথাপি কি হারে সে সময় জীবকূল বিলুপ্ত হয়েছিল তার আমাদের জানা আছে।প্যালিওসিন যুগের তথাকথিত তাপীয় বিলুপ্তি শুরু হয়েছিল, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ প্রতি মিলিয়নে ১,০০০ ভাগ হয়ে যাওয়ার পর। ট্রায়াসিক যুগের শেষে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ছিল প্রতি মিলিয়নে ১,০০০ ভাগের সামান্য বেশি। বর্তমানে বায়ুতে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ প্রতি মিলিয়নে ৩৮৫ ভাগ যা বেশ নিরাপদ বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু ভয়ের কথা হল, প্রতি বছর এই পরিমাণ প্রতি মিলিয়নে ২ ভাগ করে বেড়ে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতে ৩ ভাগ করেও বাড়া শুরু করতে পারে। সে হিসেবে আগামী শতাব্দীর শেষ দিকে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ গিয়ে দাড়াবে প্রতি মিলিয়নে ৯০০ ভাগ যার কারণে বেশ সহজেই সমুদ্রজলে অক্সিজেনস্বল্পতার সৃষ্টি হতে পারে। সেই অক্সিজেনহীনতার যুগ শুরু হওয়ার পর কতদিন লাগবে আরেকটি পরিপূর্ণ গ্রিনহাউজ বিলুপ্তি শুরু হতে? এটি এমন একটি প্রশ্ন যা কখনই আমাদের বের করার চেষ্টা করা উচিত হবে না। বরং এই মুহূর্ত থেকে আমাদের উচিত কার্বন ডাই অক্সাইড নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা।

গণ বিলুপ্তির কথকতা

* গত ৫০০ মিলিয়ন বছরে গণ বিলুপ্তির কারণে বেশ কয়েকবার পৃথিবীর জীবকূল ধ্বংস হয়ে গেছে।
* এ ধরণের একটি গণ বিলুপ্তি উদাহরণ হল ডাইনোসরদের ধ্বংস। এই বিলুপ্তির কারণ হিসেবে গ্রহাণুর আঘাতকে দায়ী করা হলেও অন্য বিলুপ্তি ঘটানাগুলোর কারণ পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায় নি।
* নতুন জীবাশ্ব ও ভূরাসায়নিক প্রমাণ থেকে বোঝা যাচ্ছে আগের বিলুপ্তিগুলো ঘটেছিল ভয়ংকর পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে। ভৌগলিক উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রতল থেকে উৎক্ষিপ্ত বিষাক্ত গ্যাসের কারণে এই বিলুপ্তিগুলো শুরু হয়েছিল। অক্সিজেনস্বল্পতাই ছিল এর প্রধান কারণ।

ধ্বংসের নমুনা

সুপ্রাচীন তিনটি বিলুপ্তি ঘটনার মধ্যে দুটিই দীর্ঘ সময় জুড়ে ঘটেছিল বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। সে যুগের ভূতাত্ত্বিক মৃত্তিকা স্তর থেকে প্রাপ্ত কার্বন-১৩ ‘র মাধ্যমে এই প্রমাণ করা হয়েছে। কোন যুগে জল ও স্থলভাগে উদ্ভিদ বেশি থাকলে বায়ুতে কার্বন-১৩ ‘র পরিমাণও বেশি থাকে। বিপুল পরিমাণে উদ্ভিদকূল ধ্বংস হতে থাকলে বায়ুমণ্ডলীয় কার্বনের সমানুপাতে কার্বন-১৩ ‘র পরিমাণ কমে যেতে থাকে। একটি সাধারণ কার্বন আদর্শের সাথে প্রাচীন নমুনায় প্রাপ্ত কার্বন-১৩ ‘র পরিমাণের তুলনা করে দেখা গেছে; পার্মিয়ান ও ট্রায়াসিক যুগের শেষ ভাগে কার্বন-১৩ অনেক কমে গিয়েছিল। এসব যুগের ক্ষেত্রে দেখা যায়, কার্বন-১৩’র পরিমাণ কখনও বেড়েছে কখনও কমেছে। কিন্তু ক্রিটাশিয়াস-টার্শিয়ারি সীমানায় দেখা যায়, এই পরিমাণ হঠাৎ করে অনেক কমে গেছে। তাই ধারণা করা হয়, এই বিলুপ্তিটি গ্রহাণুর আঘাতে হলেও অন্যগুলোর কারণ তা নয়।

ধীর বিষক্রিয়া

সম্প্রতি পার্মিয়ান যুগের শেষ দিককার বায়ুমণ্ডল ও পরিবেশের কম্পিউটার সিম্যুলেশন থেকে জানা গেছে, সে সময় সমুদ্রপৃষ্ঠের পানিতে বিষাক্ত হাইড্রোজেন সালফাইডের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়ে গিয়েছিল এবং ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছিলো অক্সিজেনের পরিমাণ। পেনসিলভ্যানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির কাৎসা এ মাইয়ার এবং লি আর কাম্প ২৫১ মিলিয়ন বছর পূর্বেকার প্যানজিয়া অতিমহাদেশের সাইবেরিয়া ট্র্যাপ্‌স অঞ্চল নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন। তাদের গবেষণা থেকে জানা যায়, ২৫১ মিলিয়ন বছর পূর্বের সময় থেকে সে অঞ্চলে অত্যধিক অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয়েছিল যার কারণে ভৌগলিক উষ্ণায়ন প্রকট রূপ ধারণ করে। এর কারণে মহাসাগরগুলো জীবকূলের জন্য প্রতিকূল হয়ে পড়ে এবং পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্র ভেঙে পড়ে।

ঘাতক গ্রিনহাউজ ক্রিয়া

একসময় ধারণা করা হতো বহির্জাগতিক বস্তুর আঘাতেই কেবল গণ বিলুপ্তি ঘটতে পারে। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণা দেখা গেছে ২৫১ মিলিয়ন বছর আগে পার্মিয়ান যুগের শেষ দিককার বিলুপ্তি ও ৫০ মিলিয়ন বছর আগে ট্রায়াসিক যুগের শেষ দিককার বিলুপ্তির কারণ এটি ছিল না। প্রকৃতপক্ষে, ভৌগলিক উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্র ও ভূভাগের জীবকূল মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছিল। গ্রিনহাউজ ক্রিয়ার ধ্বংসযজ্ঞের সূচনা হয়েছিল বিপুল পরিমাণ অগ্ন্যুৎপাতের মাধ্যমে। অগ্ন্যুৎপাতের থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণই ছিল এর কারণ। এরপর যা ঘটেছে তাকে ক্রমান্বয়ে এভাবে লেখা যায়:
০১. অগ্ন্যুৎপাতের কারণে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড ও মিথেন নিঃসরিত হয়।
০২. নিঃসরিত গ্যাসের কারণে ভৌগলিক উষ্ণায়ন ব্যাপক আকার ধারণ করে।
০৩. সমুদ্র উত্তপ্ত হয়ে পড়ায় আগের তুলনায় অনেক কম অক্সিজেন শোষণ করে।
০৪. অক্সিজেন স্বল্পতা সৃষ্টি হওয়ায় সমুদ্রজলের কেমোক্লাইন স্তর অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। সমুদ্রের একেবারে নিম্নস্তরে বসবাসকারী ব্যাক্টেরিয়া যখন বেশী পরিমাণে হাইড্রোজেন সালফাইড প্রস্তুত শুরু করে তখন নিচের হাইড্রোজেন সালফাইড সমৃদ্ধ জলস্তর উপরের দিকে উঠে আসে। ফলে অক্সিজেন স্তরের সাথে কেমোক্লাইন নামক যে স্তরের মাধ্যমে তা পৃথক ছিল সেটি ভেঙে যায়।
০৫. এভাবে চলতে থাকায় একসময় কেমোক্লাইন স্তর সমুদ্রতলে উঠে আসে। আর সেই সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস উঠে গিয়ে পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে।
০৬. জলভাগের সবুজ ও ধূসর সালোকসংশ্লেষী সালফার ব্যাক্টেরিয়া আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং অক্সিজেনের উপর নির্ভরশীল প্রাণীকূল ধ্বংসের সম্মুখীন হয়।
০৭. পরিবেশে ছড়িয়ে পড়া হাউড্রোজেন সালফাইড গ্যাস ভূভাগের জীবকূলকে ধ্বংস করে দেয়।
০৮. হাইড্রোজেন সালফাইড বায়ুমণ্ডলের ট্রপোমণ্ডলে উঠে গিয়ে ওজোন স্তরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
০৯. ওজোন স্তর না থাকায় সূর্য থেকে আসা অতিবেগুনি রশ্মি সরাসরি পৃথিবী পৃষ্ঠে চলে আসে। ফলে অবশিষ্ট জীবকূলও ধ্বংস হয়ে যায়।

আরেকটি গণ বিলুপ্তি কি সন্নিকটে?

প্রাচীন যুগের গণ বিলুপ্তি ঘটনাগুলোর সময় বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশী ছিল যার কারণে ভৌগলিক উষ্ণায়ন ত্বরান্বিত হয়। বর্তমানে আমাদের বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ প্রতি মিলিয়নে ৩৮৫ ভাগ এবং প্রতি বছর এই পরিমাণ প্রতি মিলিয়নে ২ থেকে ৩ ভাগ করে বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী শতাব্দীর শেষে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ গিয়ে দাড়াবে প্রতি মিলিয়নে ৯০০ ভাগ। ৫৪ মিলিয়ন বছর পূর্বে প্যালিওসিন তাপীয় বিলুপ্তি ঘটনার সময় বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ এর থেকে খুব বেশী ছিল না।

সুতরাং, আরেকটি গণ বিলুপ্তির কথা চিন্তা করে আমাদের কি সতর্ক হওয়া উচিত না?

লেখকঃ পিটার ডি ওয়ার্ড

তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনের জীববিজ্ঞান বিভাগ এবং পৃথিবী ও মহাকাশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। তিনি এই দুই ক্ষেত্রেই গবেষণা করেন। পার্থিব পরিপ্রেক্ষিতে তিনি প্রাচীন গণ বিলুপ্তি নিয়ে গবেষণা করেন। এর পাশাপাশি জলভাগের নটিলাসের মত প্রাণীগুলো কিভাবে বিবর্তিত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল তা নিয়ে গবেষণা করেন। অ্যামোনাইট নামক এই প্রাণীগুলোর বিবর্তনের বিষয়টি তিনি ১৯৮৩ সালের সাইন্টিফিক অ্যামেরিকানের অক্টোবর সংখ্যায় লিখেছিলেন। এছাড়া নাসার অ্যাস্ট্রোবায়োলজি ইনস্টিটিউটের জন্য তিনি প্রাচীন পৃথিবীতে কিভাবে জীবনের উৎপত্তি ও বিবর্তন ঘটেছিল তা নিয়ে গবেষণা করেন। এর মাধ্যমে নাসা বহির্জাগতিক প্রাণের সম্ভাবনা সংক্রান্ত গবেষণা চালায়। প্রাচীন পরিবেশের এই বিষয়টি নিয়ে তিনি সাইঅ্যামের অক্টোবর ২০০১ সংখ্যায় লিখেছিলেন। প্রবন্ধটির নাম ছিল, “রিফ্যুজিস ফর লাইফ ইন আ হস্টাইল ইউনিভার্স”। এটি তিনি গুইলার্মো গঞ্জালেস ও ডোনাল্ড ব্রাউনলি’র সাথে যৌথভাবে লিখেছিলেন। ব্রাউনলি’র সাথে মিলে তিনি “রেয়ার আর্থ: হোয়াই কমপ্লেক্স লাইফ ইজ সো আনকোমোন ইন দ্য ইউনিভার্স” নামে একটি জনপ্রিয় বিজ্ঞান গ্রন্থ লিখেছেন।

—————————————————————————————

মূল ইংরেজি প্রবন্ধঃ ইমপ্যাক্ট ফ্রম দ্য ডিপ; সাইন্টিফিক অ্যামেরিকান, অক্টোবর ২০০৬
লেখকঃ পিটার ডি ওয়ার্ড

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ১